কাতারের বিমানঘাঁটি থেকে উড়ে এসে মার্কিন বাহিনীর যুদ্ধবিমান সম্প্রতি কয়েক দফা আফগানিস্তানে তালেবান বাহিনীর ওপর বোমা বর্ষণ করেছে। তালেবান কর্তৃপক্ষ প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, এর মধ্য দিয়ে ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি আমেরিকা ও তালেবানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আর কোনো মূল্য রইল না। অর্থাৎ যুদ্ধটা আগের অবস্থায় ফিরে গেল। কিন্তু পার্থক্য হলো, আমেরিকার স্থলবাহিনী না থাকায় আগামী দিনে আফগানিস্তানের জাতীয় সেনাবাহিনী ও তালেবানের মধ্যে মূল যুদ্ধটা হবে। বিশ্বের বড় বড় রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী সেপ্টেম্বরের পর ছয় মাস থেকে এক বছরের মাথায় আশরাফ ঘানি সরকারের পতন হবে এবং কাবুলে ক্ষমতা দখল করবে তালেবান বাহিনী। স্থলবাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে শুধু কাতার বা পারস্য উপসাগরে অবস্থিত আমেরিকান জাহাজ থেকে মিসাইল ছুড়ে ও বিমান আক্রমণ চালিয়ে কিছুদিন বিলম্ব ঘটানো গেলেও চূড়ান্ত বিচারে তালেবান বাহিনীর ক্ষমতা দখল ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। বরং মিসাইল ও বিমান আক্রমণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আগের মতো অগণিত বেসামরিক মানুষের প্রাণ যেতে পারে, ধ্বংস হতে পারে আফগানিস্তানের রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো। ফ্যাসিস্ট, উগ্রবাদী ও শান্তি বিনষ্টকারী অপশক্তিকে দমন করার জন্য যুগে যুগে যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু একটা যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে আরেকটি যুদ্ধের জন্ম হয়েছে। প্রতিবারই তাতে লাভবান হয়েছে অস্ত্রব্যবসায়ী গোষ্ঠী, করপোরেট ব্যবসায়ী হাউস ও শাসকগোষ্ঠী। গবেষকদের অকাট্য দলিল সাক্ষ্য দেয়, প্রতিটি যুদ্ধ, দুর্যোগ ও মহামারিতে অগণিত মানুষের প্রাণ গেছে, তারা গরিব থেকে আরো গরিব হয়েছে। কিন্তু স্বল্পসংখ্যক মানুষ ধনী থেকে আরো ধনী হয়েছে। করোনা মহামারিতেও একই দৃশ্য দেখছি। আফগান যুদ্ধের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। অস্ত্রব্যবসায়ী ও আমেরিকার বেসামরিক ঠিকাদাররা লাভবান হলেও আফগানিস্তান যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে গেল। সামরিক-বেসামরিক মিলে ২০ বছরে কয়েক লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। রাজধানী কাবুলের কিছু চাকচিক্য বাড়লেও পুরো দেশ বিধ্বস্ত। ২৬ লাখ আফগান শরণার্থী হিসেবে এবং প্রায় এক কোটি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ২০ বছরে আমেরিকান বাহিনীকে যেসব আফগান বেসামরিক লোক অনুবাদ, গাড়িচালনা ইত্যাদি কাজে সহায়তা করেছে, তার সংখ্যা হবে প্রায় ৬০ হাজার, যার শতকরা ৮০ ভাগই নারী। তারা সবাই এখন দেশত্যাগ করার জন্য কাবুলে আমেরিকান দূতাবাসে ধরনা দিচ্ছে। কারণ তালেবান বাহিনী তাদের সবাইকে কচুকাটা করবে। হ্যাঁ, গত ২০ বছরে একটা লাভ হয়েছে, নারীর অগ্রগতি ঘটেছে। অনেক নারী আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি চাকরি এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনেও নারীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তালেবান ক্ষমতা দখল করার সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু ধুলায় মিশে যাবে। মাস দেড়-দুয়েক আগে মেয়েদের একটা হাই স্কুলে তালেবান বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে বহু ছাত্রীকে হতাহত করেছে।
এবার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষিতের কথায় আসি। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী কর্তৃক আফগানিস্তান দখল, তাদের হটানোর জন্য আমেরিকা, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের যৌথ তৎপরতা এবং নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি তালেবান বাহিনীকে কাবুলের ক্ষমতায় বসানোর জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ, তারপর গত ২০ বছর পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের ডাবল গেম ইত্যাদি ঘটনা বিচার-বিশ্লেষণ করলে যে উপসংহারটি আসবে তা হলো, কাবুলে তালেবান কর্তৃক ক্ষমতা দখল মানেই হলো আইএসআইয়ের বিজয় ও ক্ষমতা দখল। আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান লে. জেনারেল হামিদ গুল ২০১৪ সালে পাকিস্তানের এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেছেন, ভবিষ্যতে যখন ইতিহাস রচিত হবে তখন তাতে লেখা থাকবে আমেরিকার সহায়তা নিয়ে আইএসআই আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীকে পরাস্ত করে এবং তাতে আরো লেখা হবে, আমেরিকার সহায়তা নিয়ে আইএসআই আমেরিকাকেই পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছে (নিউ ইয়র্ক টাইমস, ১৬ এপ্রিল ২০২১)।
পাকিস্তানের মোল্লা মিলিটারি শাসকগোষ্ঠীর কাজই হলো নিজের নাক কেটে হলেও অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করা। আগামী দিনে যা ঘটতে যাচ্ছে তাতে পাকিস্তান যে শান্তিতে থাকবে তা কিন্তু নয়। পাকিস্তানি শাসকদের চোখে ভালো তালেবান কাবুলে ক্ষমতা দখল করবে। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে খারাপ তালেবান অর্থাৎ তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি), জঙ্গিগোষ্ঠী এতে উত্ফুল্ল ও উৎসাহিত হবে এবং আগের মতো পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জঙ্গি হামলা চালাবে। আগে এই জঙ্গিগোষ্ঠী টিটিপি, পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানঘাঁটিতে বড় আকারের আক্রমণ চালিয়েছে। তারা স্কুল, কলেজ, হাসপাতালে আক্রমণ চালিয়ে ছাত্র-ছাত্রী ও নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের মিলিটারি কর্তৃপক্ষ ভারতে রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারলেই খুশি। এর জন্য আইএসআইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিসংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইশ-ই-মোহাম্মদের জিহাদি তৈরির উপযুক্ত উর্বর ক্ষেত্র হবে আফগানিস্তান। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের অভিজ্ঞতা সেটাই বলে। শোনা যায়, ভারত তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য যোগাযোগ করছে। কিন্তু তাতে কতটুকু কী কাজ হবে সেটা দেখার বিষয়। বিগত দিনের ঘটনাবলি ভালো কিছু বলে না। একটা উদাহরণ দিই। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক জাহিদ হোসেন কর্তৃক লিখিত—‘ফ্রন্ট লাইন পাকিস্তান’ গ্রন্থের ৬০-৭০ পৃষ্ঠায় ঘটনাটির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আমি শুধু ঘটনাটি বলছি। ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট নম্বর আইসি-৮১৪ কাঠমাণ্ডু থেকে ১৫৫ জন যাত্রী নিয়ে দিল্লির উদ্দেশে উড়াল দিতেই ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে। ছিনতাইকারীরা বিমানটি আফগানিস্তানের কান্দাহারে নিয়ে যায়। কাশ্মীরি জিহাদি বলে তারা নিজেদের পরিচয় দেয়। পাকিস্তানের জঙ্গিসংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রধান মাওলানা মাসুদ আজাহার ও আহমদ ওমর শরিফ শেখসহ তিনজন দাগি সন্ত্রাসী নেতার মুক্তি দাবি করে, যারা বিভিন্ন সময়ে কাশ্মীর থেকে গ্রেপ্তার হয়ে ভারতের জেলে ছিল। আট দিন দর-কষাকষির পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা চাহিদামতো তিন হাই-প্রফাইল জঙ্গিকে নিয়ে কান্দাহারে হাজির হন এবং তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোল্লা আক্তার ওসমানির কাছে হস্তান্তর করেন। মোল্লা ওসমানি মাসুদ আজাহারসহ সবাইকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস প্রকাশ করেন এবং অভিনন্দন জানান। জাহিদ হোসেনের বইয়ের ৬৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, ছিনতাইকারীরা ভারতের সঙ্গে দেন-দরবারে আইএসআইয়ের কাছ থেকে নির্দেশ অনুসারে কাজ করেছে। তারপর এই মাওলানা মাসুদ আজাহারের জঙ্গিরাই ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর দিল্লিতে ভারতের পার্লামেন্ট হাউসে আক্রমণ চালায়। উপরোক্ত বইয়ের ৬৩ পৃষ্ঠায় আছে মাসুদ আজাহার ঘোষণা দেন, আমেরিকা ও ভারতকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত কোনো মুসলমানের বসে থাকা উচিত নয়। মাসুদ আজাহার ও তার জঙ্গিসংগঠন আইএসআইয়ের তত্ত্বাবধানে কাজ করে। সুতরাং কাবুলে তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইশ-ই-মোহাম্মদের মতো জঙ্গিসংগঠনগুলো উত্ফুল্ল হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাতে আগের মতো কাশ্মীরে ও ভারতের মূল ভূখণ্ডে জঙ্গি-সন্ত্রাসী আক্রমণের শঙ্কা বহু গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে।
তবে এ কথাও ঠিক, পাকিস্তানকে এবার একটু বেশি হিসাব-কিতাব করে এগোতে হবে। কাশ্মীরের উরি, পুলওয়ামা ও পাঞ্জাবের পাঠানকোট বিমানঘাঁটির মতো পুনরায় এভাবে জঙ্গি-সন্ত্রাসী লেলিয়ে দেওয়ার আগে পাকিস্তানকে অনেক ভাবতে হবে। পাকিস্তান আগের মতো সৌদি আরবের সমর্থন আর পাবে না, যেটি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের সাম্প্রতিক কিছু ভাষ্যে বোঝা গেছে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র ও প্রযুক্তি তালেবানসহ সন্ত্রাসীদের হাতে পড়তে পারে, এই শঙ্কায় আমেরিকা সার্বক্ষণিক নজরদারিসহ বিশেষ কিছু বিকল্প সামরিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তাই অনেকের ধারণা, সে রকম কিছু ঘটলে—America will go blind and that will be the end of Pakistan.
চীন অবশ্যই আফগানিস্তানের নতুন পরিস্থিতি ভারতের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। তবে জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং পাকিস্তানের অন্য বেপরোয়া জঙ্গিসংগঠন টিটিপির সঙ্গে তালেবান সরকারের কী ধরনের সম্পর্ক হবে, সেটি চীনকে বারবার ভাবাবে। বাংলাদেশের সতর্ক হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। জামায়াত, হেফাজত উত্ফুল্ল হবে এবং বাংলাদেশের জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের হেফাজতের জায়গা হবে আফগানিস্তান। পাকিস্তান এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইবে। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বহনকারী দল বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকুক তা পাকিস্তানের জন্য মোটেই সুখকর নয়। দ্বিতীয়ত, জামায়াত, হেফাজত ও জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের অর্থ, অস্ত্রসহ সব রকমের সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে পাকিস্তান চাপে রাখার চেষ্টা করবে, যাতে একাত্তরের সব ভুলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশ আগ্রহী হয়। এই অপচেষ্টা পাকিস্তান ১২ বছর ধরে করে আসছে। কিন্তু একাত্তরের হিসাব-কিতাব ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ অন্য কিছু মেনে নেবে না। আফগানিস্তানে তালেবান আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য তো দুঃসংবাদ বটেই, তার সঙ্গে উত্তর আফ্রিকা থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত যত উগ্রবাদী জঙ্গিসংগঠন আছে তারা উদ্বুদ্ধ হবে। সুতরাং আমেরিকান সেনারা যে আফগানিস্তান রেখে যাচ্ছে তা ক্রমেই একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হবে এবং বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক অঙ্গনে জঙ্গি-সন্ত্রাসী রপ্তানির উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠবে, যা আগামী দিনে আমেরিকার জন্যও নতুন সংকট সৃষ্টি করবে।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
sikder52@gmail.com