দেশে করোনার সংক্রমণ এখন গত দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বাড়ছে। এর কাছে মানুষ অসহায়। দেশের বিদ্যমান চিকিৎসাব্যবস্থা তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিদিনের আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিলকে থামাতে পারছে না। কারণ এত রোগী সামাল দেওয়ার মতো অবকাঠামো আমাদের নেই। সব হাসপাতালে উপচে পড়ছে কভিড রোগী। কিন্তু এমনটি ঘটল কেন?
আমাদের দেশের অবস্থা তো তুলনামূলকভাবে ভালোই ছিল। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ হিসেবে এখানের প্রখর রোদে থাকা কিছু অতিবেগুনি রশ্মি আর ভেজা আবহাওয়া খোলা বাতাসে ভাসমান করোনাভাইরাসকে বেশিক্ষণ টিকতে দেয় না, নইলে বাতাসে ভেসে এটি বেঁচে থাকতে পারত কমপক্ষে তিন ঘণ্টা। তা ছাড়া আমাদের বাল্যকালে নেওয়া বিসিজি ভ্যাকসিন, বাঙালির খাবারে থাকা প্রচুর ফ্ল্যাভনয়েড ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান, সেই সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন মসলার প্রাকৃতিক গুণ (ভেজালমুক্ত হলে), মেহনতি মানুষের শরীরের প্রাকৃতিক বর্ধিত ইমিউনিটি, বছরজুড়ে এই করোনার কাজিনদের সৃষ্ট সর্দি-কাশির বিস্তার, সর্দি লাগলে নাকে গরম পানির ভাপ নেওয়া ও সরিষার তেল ব্যবহারের মতো টোটকার মাধ্যমে সাময়িক স্বস্তি পাওয়া ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ গত বছরে বেশ কম ছিল। আবহাওয়া, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার মিল ইত্যাদির ফলে পাশের দেশ ভারতেও করোনার সংক্রমণ তেমন বেশি ছিল না। কিন্তু তারপর তা বাড়ল কেন?
গত বছরজুড়ে মানুষের মধ্যে করোনার আতঙ্কজনিত স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানার সচেতনতা থাকলেও এ বছরের শুরু থেকেই এই দুই দেশের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে একটা গা ছাড়া ভাব চলে আসে। লোকজন মাস্ক পরা প্রায় ছেড়েই দিল। ভিড়াক্রান্ত স্থান পরিহার করবে দূরের কথা, ভিড়ের মধ্যে না গেলে যেন তাদের চলছিল না। পক্ষান্তরে হাত ধোয়াসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি যাঁরা মেনে চলতেন তাঁরা হাসিঠাট্টার পাত্র হলেন। তা ছাড়া বদ রাজনৈতিক কারণে টিকা সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টিকারী মতলবি লোকজনের আধিক্য দুটি দেশেই ছিল। দুটি দেশেই ধর্মীয় নেতারা নিজ নিজ স্বার্থে ‘আমাদের কিছু হবে না’ বলে অপপ্রচার চালাতে লাগলেন। দুটি দেশের ইন্টারনেটেই এই অপপ্রচার জোরদার হলেও তা প্রতিরোধ করার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশে এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কিছু সমালোচনা হলেও ভারতে বরং তা কোনো কোনো সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আশকারা পেয়েছে। তার সঙ্গে দুটি দেশেই যোগ হয়েছে কিছু বিকৃত সত্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যাকে বলছে ‘মিসইনফরমেশন’, যে যোগাসন, ব্যায়াম, সঠিক খাবার এগুলোর মাধ্যমে শরীরের প্রাকৃতিক সুরক্ষা বা ইমিউনিটি বাড়াতে পারলে এসব টিকা বা মাস্ক বা ওষুধের প্রয়োজন হবে না। এসব বিকৃত সত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর। কারণ মানুষ এতে সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত হয়।
শরীরের ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য যোগচর্চা, ব্যায়াম, খাবার, সূর্যালোক ইত্যাদির ভূমিকা অবশ্যই আছে। এগুলো করা অবশ্যই উচিত। কিন্তু সেই সঙ্গে সবচেয়ে সংক্রামক এই ভাইরাসটি যাতে শরীরে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য মাস্ক পরা, কিছুক্ষণ পর পর হাত ধোয়া, লোকজনের ধারেকাছে না যাওয়া, টাকা গুনতে বা বইয়ের পাতা ওল্টাতে জিহ্বা দিয়ে আঙুল ভিজিয়ে না নেওয়া, জরুরি কারণ ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়া, লকডাউন দিলে ঘরে থাকা ইত্যাদি করতে হয়। আর যদি শরীরে ভাইরাসটি প্রবেশ করেই যায়, তাহলে যেন ভাইরাসের বংশ বৃদ্ধি করে শরীরের ক্ষতি করতে না পারে তার জন্য টিকা নিতে হয়। কিন্তু শরীরের ইমিউনিটি বাড়িয়ে টিকা, মাস্ক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধিকে তাচ্ছিল্য করা কোনোক্রমেই উচিত নয়। অথচ বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই তা বেশি করেই করা হয়েছে।
ভারতে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে লাখ লাখ মানুষ যেভাবে হোলি উৎসব, কুম্ভমেলা, গঙ্গাস্নান, রাজ্যভিত্তিক নির্বাচন ইত্যাদিতে যোগ দিয়েছে—মিডিয়ায় তার ছবি দেখেই আমরা বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছিলাম যে জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী এসব লোক ভারতকে মহাবিপদে ফেলবে। পরম দুঃখের বিষয়, তা-ই হয়েছে। করোনাভাইরাস একজন থেকে আরেকজনে সংক্রমিত হতে লাগল। সেখান থেকে আবার আরেকজনে। এভাবে ছড়াতেই থাকল। বিজ্ঞানের মতে, একজন করোনাক্রান্ত ব্যক্তি এক দিনে ৪১ জনকে সংক্রমিত করতে পারে। পরের দিন যদি এই ৪১ জনের প্রত্যেকে আরো ৪১ জন করে রোগটি ছড়িয়ে দেয়, তাহলে একজন থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এক হাজার ৬৮১ জনের মধ্যে রোগটি ছড়াতে পারে। ভাইরাসটি যত ছড়াবে ততই সে নিজের রূপান্তর ঘটাতে পারে। একজন থেকে আরেকজনে না ছড়ালে তার এই রূপান্তর ঘটে না।
এই রূপান্তরগুলো ভালো-খারাপ দুদিকেই হতে পারে। ভালো অর্থাৎ কম ক্ষতিকর। এভাবে একসময় সে বিবর্তন হতে হতে নির্জীব হয়ে যায়। কিন্তু খারাপ দিকে যদি রূপান্তর হয়, তাহলে তাকে বলা হয় ‘ভেরিয়েন্ট’। ভেরিয়েন্টের জন্ম হয় মাঝেমধ্যে। এই ভেরিয়েন্টগুলো হয় খুবই আগ্রাসী ও বহুগুণ বেশি সংক্রামক। যে দেশে এই ভেরিয়েন্টের জন্ম হয় সেই দেশের নামে এগুলোকে নামকরণ করা হয়। পৃথিবীতে যে কয়েকটি ভেরিয়েন্ট, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নাম কুড়িয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে ইউকে ভেরিয়েন্ট, সাউথ আফ্রিকান ভেরিয়েন্ট, ব্রাজিলিয়ান ভেরিয়েন্ট, ইন্ডিয়ান ভেরিয়েন্ট ও পেরু ভেরিয়েন্ট। এগুলোর মধ্যে আবার আমাদের দেশে এবং প্রায় সারা পৃথিবীতেই এখন ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে ইন্ডিয়ান ভেরিয়েন্ট।
এই বছরের শুরু থেকে যদি ভারতের লোকজন বেপরোয়া আচরণ না করে মাস্ক পরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলত, তাহলে এই ইন্ডিয়ান ভেরিয়েন্টের জন্ম হতো না, আর বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর মানুষকে আজ এই দুর্দশায় পড়তে হতো না। কোনো দেশকে যাতে বিব্রত হতে না হয় সে জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এসব ভেরিয়েন্টের নতুন নামকরণ করেছে যথাক্রমে আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা ও লেমডা ভেরিয়েন্ট।
ভারতের মতো আমাদের দেশেও এ বছরের তৃতীয় মাস থেকে করোনার সংক্রমণ মারাত্মক হারে বাড়তে লাগল মাস্ক না পরা, স্বাস্থ্যবিধিগুলো না মানা, গাদাগাদি মানুষের ভিড়, টিকা নিতে অনীহা ইত্যাদি কারণে। ভারত থেকে যারা এলো তাদের অনেকে এই ডেল্টা ভেরিয়েন্ট নিয়ে এসে নিজেদের গ্রামে ছড়াল। গ্রামের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হতে লাগল। তার পরও মানুষ মাস্ক পরল না। তার পরও মানুষ কোনো স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গায়ে গা লাগিয়ে চলাফেরা করতে লাগল।
এরপর এলো ঈদুল ফিতর। সরকার চাইল সংক্রমণের এই মারাত্মক অবস্থায় যাতে এবার লোকজন গাদাগাদি করে শহর থেকে গ্রামে না যায়, সে জন্য ঈদের ছুটি কমিয়ে তিন দিন করা হলো। ভিন্ন নামে লকডাউন দেওয়া হলো। বেসরকারি কারখানার মালিকদের সরকার নির্দেশ দিল যেন তিন দিনের বেশি কেউ ছুটি না দেয়। ফলে শ্রমিকরা নিরুৎসাহ হবে, তারা গ্রামে যাবে না। কিন্তু বেশির ভাগ গার্মেন্ট মালিক এই নির্দেশ না মেনে সাত দিন বা তারও বেশি ছুটি দিলেন। ফল যা হওয়ার তা-ই হলো। সরকারের উদ্দেশ্য কার্যকর হলো না। শহরের লোকজন নিজেদের শরীরে বহন করা ভাইরাস গ্রামে রেখে এলো। ফলে গ্রামেও করোনার সংক্রমণ বাড়তে লাগল।
সাম্প্রতিক সময়ে ঈদুল আজহায়ও মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে, মাস্ক না পরে আবার মার্কেটে, গরুর হাটে, গ্রামে গেল। সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের বেশি হলেই যেখানে দুশ্চিন্তায় জনস্বাস্থ্যবিদদের কপালে ভাঁজ পড়ে, সেখানে এত বেশি সংক্রমণের হার, এত মানুষ যে মারা যাচ্ছে, অথচ দেশের অনেক মানুষের কোনো দুশ্চিন্তা নেই।
টিকা নিয়ে এত দিন উদ্বেগ ছিল। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে জনগণকে টিকা দেওয়া শুরু না হলেও ছোট দেশ বাংলাদেশ তা শুরু করেছিল ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। ভালোভাবেই চলছিল। হঠাৎ ভারতের লোকদের বেপরোয়া চলাফেরার জন্য সেখানে করোনার হার বেড়ে যাওয়ায় তারা আমাদের অগ্রিম কেনা টিকাগুলো দিতে পারল না। ফলে কিছুদিন আমাদের অসুবিধা হয়েছিল। কিন্তু এখন টিকার সে সংকট নেই। সরকার এরই মধ্যে প্রচুর টিকা সংগ্রহ করেছে। সামনের দিনগুলোতেও আর এখন টিকা সংকটের আশঙ্কা নেই।
এই পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী সরকার ১৮ বছর বয়সকে ভিত্তি ধরে শহরের ওয়ার্ড এবং গ্রামের ইউনিয়ন পর্যায়ে গণটিকা কার্যক্রম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের যে বিশাল নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের রয়েছে সরকার তা কাজে লাগিয়ে এই টিকা দেবে। এখন টিকা নেওয়ার জন্য কোনো কম্পিউটারে রেজিস্ট্রেশন লাগবে না। জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়েই টিকা নেওয়া যাবে। যথাসম্ভব দ্রুত বেশিসংখ্যক মানুষকে এভাবে টিকা দেওয়া হবে। আমাদের বিনীত পরামর্শ অনুযায়ী সরকার আগামী ৭ আগস্ট থেকে এভাবে গণটিকা কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে বলে সরকারকে অভিনন্দন জানাই। এখন সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে এতে ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
টিকা নেওয়া বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সর্বাত্মক অপপ্রচার সত্ত্বেও এরই মধ্যে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ টিকা নিতে নাম রেজিস্ট্রি করেছেন। মিথ্যার মায়াজাল সরিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারার জন্য তাঁদেরকেও অভিনন্দন।
এখনো যাঁরা টিকা নিতে পারেননি বা নেননি, সবাই টিকা নিন। কেউ যেন বাদ না থাকে। আসুন, এই গণটিকা কার্যক্রম সফল করতে নাগরিক হিসেবে নিজেরাও হাত লাগাই। টিকা নেওয়ার সুবিধাগুলো সবাইকে জানাই। টিকা নেওয়ার পর সবাই যদি মাস্ক ব্যবহার করি, তাহলে আর লকডাউনের প্রয়োজন হবে না।
সরকার লকডাউন দিলে যারা বিভিন্ন কথা বলে, এর বিরোধিতা করে তারা কিন্তু সংক্রমণ কমানোর লক্ষ্যে বিকল্প কোনো পন্থা দেখাতে পারেনি। কিন্তু আমরা জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞানের নির্ধারিত পথরেখা অনুযায়ী জানাতে চাই যে টিকা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার শুরু করলে লকডাউনের আর কোনো প্রয়োজন হবে না এবং এরপর মাত্র তিন সপ্তাহ পার করতে পারলে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব। অর্থাৎ সর্বজনীন টিকা ও সর্বজনীন মাস্ক—মাত্র এই দুটি অস্ত্র দিয়েই আমরা করোনাকে পরাজিত করতে পারব। তার জন্য কঠিন কোনো সাধনা করতে হবে না। কিন্তু তা যদি দেশের মানুষ না করে তাহলে করোনার সঙ্গে এই কষ্টকর সহাবস্থান, অতল ভোগান্তি, সংক্রমণের আতঙ্ক আর দুঃখজনক মৃত্যু চলতেই থাকবে।
লেখক : অধ্যাপক, পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।