বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের সম্পর্কে বলা হয়, তাঁরা প্রত্যেকেই একটি রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। সবারই যে রাজনৈতিক দর্শন থাকে, তা নয়। কিন্তু বিজ্ঞ প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট মার্কিন জাতিকে একটি করে কল্যাণকর রাজনৈতিক দর্শন উপহার দিয়েছেন। যেমন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্ট জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন নিউ ডিল। এই নিউ ডিলের ফলে আমেরিকার তখনকার ভাঙা অর্থনীতি আবার জোরালো হয়ে উঠেছিল।

প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির রাজনৈতিক দর্শন ছিল ‘নিও ফ্রন্টিয়ার’। এমন যে আমেরিকার নিকৃষ্টতম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তাঁরও একটা রাজনৈতিক দর্শন ছিল, তা ছিল ‘নিও ফ্যাসিবাদ’। এই দর্শনের ভয়াবহতা থেকে সারা বিশ্ব এখনো মুক্ত হতে পারেনি। আমাদের উপমহাদেশের বড় অনেক নেতার ভালো-খারাপ রাজনৈতিক দর্শন ছিল। মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক দর্শন ছিল রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা। জিন্নাহর দর্শন ছিল ভারত ভাগ ও মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। নেহরুর রাজনৈতিক দর্শন ছিল অসাম্প্রদায়িক মডার্ন ইন্ডিয়া গড়ে তোলা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও একটি রাজনৈতিক দর্শন ছিল। তা হলো গান্ধীর রামরাজত্ব এবং জিন্নাহর মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দর্শনের বিপরীত একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। তাঁর এই রাজনৈতিক দর্শনের কথা আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতারা জানেন, কিন্তু অনুসরণ করেন না। তাঁরা প্রত্যেকেই বক্তৃতা দেওয়ার সময় বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী।’ কিন্তু এই আদর্শটা কী, তাঁরা তা বোঝেন না অথবা বুঝতে চান না।

রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের রাষ্ট্রদর্শনটি ছিল স্পষ্ট। তিনি বাংলাদেশে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁকে হত্যার পর যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা শোষকের গণতন্ত্র। শোষক ও শোষিতের গণতন্ত্রের মধ্যে বিরাট পার্থক্যটা কেউ কখনো স্পষ্ট করে তুলে ধরেননি; যদিও পার্থক্যটা ছিল স্পষ্ট।

বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাকালে ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ গ্রন্থের লেখক প্রয়াত খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ‘মুজিববাদ’ নামে এক বিশাল গ্রন্থ লিখেছেন। তাতে আদিম সাম্যবাদী যুগ থেকে কার্ল মার্ক্সের ‘সর্বহারার রাষ্ট্র’ পর্যন্ত সব দর্শনের বিস্তারিত বিবরণ আছে, মুজিববাদের নেই। এই বইয়ের সমালোচনা করতে গিয়ে এক ভারতীয় সাংবাদিক লিখেছিলেন, ‘নেহরুবাদ ও মুজিববাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। নেহরু ধর্মনিরপেক্ষতা ও মিশ্র অর্থনীতির ভিত্তিতে মডার্ন ইন্ডিয়া গড়তে চেয়েছিলেন, শেখ মুজিবও নেহরুর অনুকরণে ধর্মনিরপেক্ষতা ও মিশ্র অর্থনীতির ভিত্তিতে মডার্ন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মুজিবিজম বলতে কিছু নেই, যা মুজিবিজম, সেটাই নেহরুইজম।’

কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় লেখাটি বেরিয়েছিল। আমি তখনই ভারতীয় সাংবাদিকের এই লেখার সমালোচনা করি। আমার লেখাও যুগান্তরেই প্রকাশিত হয়েছিল। আমি লিখেছিলাম, মার্ক্সবাদ ও মাওবাদ যেমন অভিন্ন দর্শন নয়, যদিও বাইরের দৃষ্টি থেকে মনে হয় দুটিই কমিউনিজমের অভিন্ন রূপ; তেমনি নেহরুবাদ ও মুজিববাদ অভিন্ন দর্শন মনে হতে পারে; কিন্তু তা নয়। নেহরু ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে মডার্ন ইন্ডিয়া গড়তে চেয়েছিলেন। তিনি সমাজতন্ত্রী ভারত চাননি। যৌবনে তিনি হ্যারল্ড লাস্কির প্রভাবে সোশ্যালিস্ট হয়েছিলেন।

ভারতের সোশ্যালিস্টরা আশা করছিলেন, বিলাত থেকে ছাত্রজীবন শেষ করে নেহরু দেশে ফিরে সোশ্যালিস্ট দলে যোগ দেবেন ও নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু দেশে ফিরে তিনি সোশ্যালিজমে বিশ্বাস হারান। গান্ধীর প্রভাবে গান্ধীবাদে বিশ্বাসী হন এবং কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাব এড়াতে পারেননি। ফলে বাঙালি সুভাষের সর্বভারতীয় নেতৃত্বকে ধ্বংস করার চেষ্টায় হাত মিলিয়েছেন। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ভারতে ধনবৈষম্য ও আয়ের অসাম্য দূর করার ব্যবস্থা করেননি। টাটা বিড়লাদের স্বার্থে হাত দেননি। জাতীয় বৃহৎ সম্পদ রাষ্ট্রায়ত্ত করেননি। মিশ্র অর্থনীতি প্রবর্তনের নামে অর্থনীতিতে দুর্বল পাবলিক সেক্টর গড়ে তুলেছেন, যা প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সম্পূর্ণ অনুপযোগী ছিল।

তবু নেহরু ধর্মনিরপেক্ষতাকে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের মূলমন্ত্র করেছিলেন এবং সম্রাট আকবরকে ‘ফাদার অব দ্য ইন্ডিয়ান নেশন’ মনে করতেন—এটাই বড় কথা। পক্ষান্তরে শেখ মুজিবের ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল বুর্জোয়া গণতন্ত্রভিত্তিক নয়, বরং সমাজতন্ত্রভিত্তিক। শেখ মুজিব প্রথম জীবনে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সোশ্যালিস্ট নেহরু যেমন বিলাত থেকে দেশে ফিরেই গান্ধীবাদী হয়ে গিয়েছিলেন, শেখ মুজিবের জীবনে তা ঘটেনি। সোহরাওয়ার্দীর পশ্চিমা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রভাব তিনি কাটিয়ে উঠেছেন খুব তাড়াতাড়ি।

সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর তাঁর প্রবীণ সহকর্মীদের বাধা উপেক্ষা করে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগকে সমাজতন্ত্রভিত্তিক গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আদর্শে পুনর্গঠন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ করা ছাড়া বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র অথবা ধর্মনিরপেক্ষতা কোনোটাই প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তিনি সরাসরি বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যাননি। তিনি জানতেন, বাংলার সামাজিক ব্যবস্থা এখনো পূর্ণ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উপযোগী নয়। মার্ক্সও বলেছিলেন এ কথা। ‘যে দেশে ধনতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি, সে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।’—চীনের বিপ্লবে মাও জেদং এই সত্যটা বুঝেছিলেন। চীনের সামন্তবাদী সমাজে তাই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে তিনি নয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নয়া চীনের নামও সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক না রেখে পিপলস রিপাবলিক রেখেছিলেন।

শেখ মুজিব সমাজতন্ত্রী বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য গোপন করেননি। তিনি তাঁর দলের অন্যতম আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন। রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে যুক্ত করেছেন। তিনি জাতীয় সম্পদ রেলওয়ে, ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স কম্পানি এবং বড় শিল্প সরাসরি রাষ্ট্রায়ত্ত করেছিলেন। শ্রেণিভেদ ঘোচানোর জন্য আইনজীবীদের মধ্যে ব্যারিস্টার ও উকিলদের পার্থক্য বিলুপ্ত করেছিলেন। সংবাদপত্রের প্রুফ রিডারদের সাংবাদিকের স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজে সাহসের সঙ্গে পা রেখেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু বারবার বলতেন, ‘ব্রিটিশরাজ ভারতকে স্বাধীনতা দেয়নি। স্বাধীনতা দেওয়ার নামে তাদের ট্রেনিং দেওয়া সিভিল সার্ভেন্টদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে গেছেন। রাজনীতিকরা এই সিভিল সার্ভিসের হাতের পুতুল মাত্র। বাংলাদেশে এটা হতে পারেনি। কারণ এখানে সশস্ত্র গণযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখানে ভেঙে পড়া মিলিটারি ও সিভিল সার্ভিস বিলুপ্ত করে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা পৌঁছে দিতে হবে। তাহলে দেশ থেকে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা দূর হবে। জনগণের মধ্যে যদি ইকোনমিক ডিসপ্যারিটি দূর হয়, তাহলে অন্যান্য বৈষম্য যেমন ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতাও দূর হবে।’

জাতীয় সম্পদে আমলাতন্ত্র ও ধনীদের বহু যুগের আধিপত্য লুপ্ত করার জন্যই তিনি দ্রুত তা রাষ্ট্রায়ত্ত করেছিলেন। আইয়ুবের সৃষ্ট গ্রামীণ বুর্জোয়া সমাজ বিলুপ্ত করার জন্য মৌলিক গণতন্ত্র প্রথা ভেঙে দিয়ে ডিস্ট্রিক্ট কমিশনারের বদলে নির্বাচিত জেলা গভর্নরের প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। জওয়াহেরলাল নেহরু ভারতে পশ্চিমা বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ভারতের টাটা বিড়লাদের গায়ে হাত দেননি। শেখ মুজিব বাংলাদেশের আদমজী, বাওয়ানীর গায়ে হাত দিয়েছেন। এক উঠতি বাঙালি শিল্পপতি, যিনি আওয়ামী লীগের ফান্ডে মোটা ডোনেশন দিতেন, তিনিও বাংলাদেশে বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তিত হওয়ার পর পালিয়ে গিয়ে লন্ডনে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে তাঁর অফিস খোলেন। তাঁর সঙ্গে এসে উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন পাকিস্তানের মাহমুদাবাদের নবাব সাহেব। বাংলাদেশের অনেক নব্য ধনী ও নব্য শিল্পপতিদের এই সময় লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটের এই অফিসে এসে জড়ো হতে দেখা যেত। অনেকে মনে করেন, এই অফিসে মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রও প্রাথমিকভাবে পাকানোর চেষ্টা হয়েছিল।

আমার বলার কথা, শেখ মুজিবের রাষ্ট্রদর্শন ছিল শোষিতের গণতন্ত্র। তখন কেউ কেউ বলেছেন, সঙ্গে আওয়ামী লীগের মতো একটি পেটি বুর্জোয়া পার্টি এবং পাকিস্তানের ট্রেনিংপ্রাপ্ত সিভিল ও মিলিটারি ব্যুরোক্রেসির সাহায্যে শেখ মুজিব বাংলাদেশে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। এ ব্যাপারে ইতিহাসের রায় কী হবে তা আমরা জানি না।

সমাজতন্ত্রী শিবিরের পতন এবং গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের রিসারজেন্সের পর আবার একদল বলেছে, সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা এখন অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে যে পথ ধরেছেন, শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে এখন তাঁকেও সে পথ ধরতে হতো। এটিও একটি বিতর্কমূলক কথা। ইরানে খোমেনির ইসলামী বিপ্লবের পর লন্ডনে এক বামপন্থী সাংবাদিক আমাকে বলেছিলেন, ‘সব ধর্মীয় দর্শনকে আমরা যখন বিলুপ্ত মনে করছি, তখন দেড় হাজার বছর পর ইসলাম ইরানে বিপ্লবী চেহারা নিয়ে জেগে উঠছে। তাহলে মার্ক্সবাদ একটি বৈজ্ঞানিক দর্শন হয়ে আবার জেগে উঠতে পারবে না কেন?’ জেগে উঠতে যে পারবে তার প্রমাণ আবার দেখা যাচ্ছে ইউরোপে ও লাতিন আমেরিকায়। বাংলাদেশেও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন পরাজিত হয়নি। সাময়িকভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে। তার পুনর্জাগরণের কোনো লক্ষণ কি দেশে নেই? এটা সত্য, শেখ হাসিনা এখন বুর্জোয়া গণতন্ত্রের খুঁটিটা আগলে আছেন। তিনি যদি গণতন্ত্রের এই খুঁটিটাই আগলে রাখতে পারেন, তাহলে এই খুঁটিই শোষিতের গণতন্ত্রের দুয়ার খুলে দেবে। এই দুয়ার খুলবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী অনাগত এক বিপ্লবী তরুণসমাজ। তাদের পদধ্বনি এখনো শোনা যাচ্ছে না। সময়মতো শোনা যাবে। সৌদি আরবের মতো কট্টর দেশে যে ওয়াহাবিজমের পতন শুরু হবে তা কি দুই বছর আগেও বোঝা গিয়েছিল?

লন্ডন, সোমবার, ২ আগস্ট ২০২১

শেয়ার করুন