জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনার তদন্তে একটি কমিশন গঠনের দাবি অনেক দিনের। তবে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসকে কেন্দ্র করে এই দাবি বেশ জোরালোভাবে উঠেছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, করোনা মহামারির প্রকোপের কারণে এই উদ্যোগ কিছুটা স্থিমিত হয়ে যায়। করোনার প্রকোপ কমলেই কমিশন গঠন হবে।
বছরখানেক আগে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হলেও এর পেছনের নানা যড়যন্ত্র এবং এর বিচারের আওতার বাইরে যারা রয়ে গেছে তাদের চিহ্নিত করার জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হবে। যদিও গত এক বছরে এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
রোববার শোক দিবসের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনে যারা ছিল তাদেরকে খুঁজে বের করতে, তাদেরকে চিহ্নিত করতে একটি কমিশন গঠন করা হবে। আরও আগেই হয়তো কমিশন গঠন হয়ে যেত। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে একটু বিলম্ব হচ্ছে। করোনার প্রকোপ কিছুটা কমে এলে কমিশন গঠন করব।’
মন্ত্রী বলেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বলেছেন, যারা এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল, তাদেরকে চিহ্নিত করে বাংলার মানুষের কাছে সাক্ষ্য-প্রমাণসহ তাদের মুখোশ উন্মোচন করার জন্য একটি কমিশন হওয়া প্রয়োজন। এই কমিশনের মাধ্যমে আইনিভাবে যারা এই হত্যাকাণ্ডের কুশীলব ছিল, যারা নেপথ্যে থেকে লাভবান হওয়ার জন্য এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদেরকে চিহ্নিত করে জনগণের সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করা হবে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত শোক দিবসের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি বলেন, আমলা তন্ত্রেও মুস্তাকের দোসর মাহবুবুল আলম চাষী, কেরামত আলী, শফিউল আলম, আবদুল মোমেন খান (বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খানের বাবা) এই যে দুষ্ট চক্র (আমলাদের) তারা কিন্তু রয়ে গেছে। আমাদের তদানিন্তন সময়ে এনএসআই-এর ডাইরেক্টর ছিলেন এবিএম সাত্তার, বঙ্গবন্ধুর সচিব ছিল পাকিস্তানের রাজাকার বাহিনীর সদস্যদ রিক্রুট করা আব্দুর রহিম। এরা কিন্তু নেপথ্যেই থেকে গেছে এবং তাদের সহযোগীও আরও অনেক ছিলেন, এদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানাব, আপনারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যারা জড়িত ছিল তাদেরকে চিহ্নিত করতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করুন। ব্যবসায়ীদের মধ্যে কারা সেদিন সুযোগের অপেক্ষায় বসেছিল, সাংবাদিকদের মধ্যে কারা সেদিন মুস্তাকের সরকারের বৈধতার পক্ষে কলম ধরেছিল?, সেই খ্যাতিমান বা কুখ্যাত সাংবাদিকবৃন্দ কারা? এটিও খুঁজে বের করা প্রয়োজন। যদিও তাদের অনেকেরই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়, এমনকি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়েও প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমরা তাদেরকে খুঁজে বের করতে পারিনি। খুঁজার চেষ্টাও করিনি। এখনই সময় এদেরকে চিহ্নিত করার।
জাতীয় শোক দিবসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘জাতির পিতার হত্যায় মঞ্চের কুশীলবদের বিচার করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এর বাইরে যারা ষড়যন্ত্রকারী ছিল, তদন্ত কমিশন করে তাদেরও খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা হবে।’
এদিকে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ জাতীয় শোক দিবসের একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘দেশ থেকে পঁচাত্তরের শত্রুদের বিনাশ করতে হলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার সঙ্গে জড়িত দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারী নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।’
জুরাইনে একটি অনুষ্ঠানে একই দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব ড. মো. আওলাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যের নায়কদের ষড়যন্ত্র উদঘাটন ও জড়িতদের আইনের আওতায় এনে মরণোত্তর বিচার করতে হবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসও একটি কমিশন গঠনের দাবি তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘সাক্ষ্য-প্রমাণে স্পষ্ট– খুনি জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যায় সর্বাত্মকভাবে জড়িত ছিল; জাতিকে পরিপূর্ণভাবে কলঙ্কমুক্ত করতে কমিশন গঠন করে খুনি জিয়ার প্রতীকী বিচার হলেও সম্পন্ন করা দরকার।’
কমিশন গঠনে সরকারের উদ্যোগ কতদূর এগোলো?
যদিও তদন্ত কমিশনটি এক বছরে আলোর মুখ না দেখায় সরকার এই ব্যাপারটিকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। রাজনীতির বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই তদন্ত কমিশনের সদস্য কারা হবেন সেটা ঠিক করতেই সরকারের বিলম্ব হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বিবিসিকে বলেন, ‘কমিশনে দলের লোক থাকলে সেখানে একপেশে ইতিহাস হতে পারে, আবার নিরপেক্ষ কেউ থাকলে সেটা তারা মানবেন কি না সেটা নিয়েও সংশয় থেকে যাবে।’
নাসরিন বলেন, ‘তদন্ত কমিশনের কাজ হবে একটা ইতিহাসকে খুঁড়ে বের করা। সেই খোঁড়াখুঁড়ির জায়গাটাতে কে থাকবেন সেটা তারা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। প্রলম্বিত হওয়ার পেছনে এটা কাজ করছে যে কে কে থাকবেন কমিশনে। তারা এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। কারণ রাজনীতি।’
ঘটনার প্রায় ৩৫ বছর পর ২০১০ সালে সেই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সাবেক সেনা সদস্যদের মৃত্যুদণ্ড হয়। আদালতের রায়ে হত্যাকাণ্ডের পেছনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ ছিল, কিন্তু বিস্তারিত কিছু উঠে আসেনি।
সরকার তদন্ত কমিশনকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, সেই প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলন, ‘প্রথমে দরকার ছিল বিচার করার এবং সেই বিচার হয়েছে। আজ যারা তদন্তের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলছে তাদের নিয়ে আমি কোনো সন্দেহের চোখে দেখছি না। কিন্তু তাদের বক্তব্যটা নিঃসন্দেহে মানুষের মনে তাদের ব্যাপারে প্রশ্ন সৃষ্টি করবে।’
বিরোধী দল বিএনপির নেতারা তদন্ত কমিশন গঠনের কথা ওঠার পর গত বছর বলেছিলেন, তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে টার্গেট করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই কমিশন করা হচ্ছে কি না এই প্রশ্ন তাদের রয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এই কমিশন ‘উইচহান্টিং’ করবে না। যারা জীবিত নেই তাদের বিচার- এটাও কমিশন করবে না। যড়যন্ত্রে তাদের যে ভূমিকা ছিল সেটা সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে জনসমক্ষে প্রকাশ করবে।’