বেদনাবিধুর ১৫ আগস্ট: নেপথ্যের কথা জানতে চাই

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি
র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি। ফাইল ছবি

বেদনাবিধুর ১৫ আগস্ট আবার আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। ১৯৭৫ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, দুই কন্যা ব্যতীত সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল খন্দকার মোশতাক এবং সেনাবাহিনীর দলছুট একদল ঘাতক সেনা অফিসার। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা নিহত হলেন স্বদেশের সদলের চক্রান্তকারীদের দ্বারা। নেপথ্যের খলনায়করা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, পাকিস্তান, সৌদি আরব আর লিবিয়া।

উপমহাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এবং তাদের এদেশীয় দোসর মুৎসুদ্দি আমলা গোষ্ঠী ও লুটেরা ধনিক গোষ্ঠী এই ঘাতকদের সহযোগী ছিল। বঙ্গবন্ধু সরকারের উৎখাতের পর ক্রমান্বয়ে ক্ষমতাসীন মোশতাক-জিয়া-সাত্তার আর এরশাদের রাজনৈতিক আর্থিক ও সাংস্কৃতিক নীতিনির্ধারণ থেকেই আমাদের বক্তব্যের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যাবে। গণতান্ত্রিক রাজনীতি, শোষণমুক্ত অর্থনীতি আর আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির বিপরীতে (এই আদর্শিক বিষয়াদি বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসিক্ত অবস্থান) সামরিক-বেসামরিক-আমলা আর মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ী চক্রের রাজনীতি, কায়েমি স্বার্থের অবাধ পুঁজিবাদী অর্থনীতি আর সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি প্রতিস্থাপনের দর্শনকে এগিয়ে নেওয়াই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও ক্ষমতাচ্যুত করার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল।

কেননা স্বাধীন বাংলাদেশ এবং এর প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের আদর্শিক অবস্থান পাকিস্তানের অভ্যন্তরে গজিয়ে ওঠা নব্য ধনিক-বণিক শ্রেণি ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সুযোগসন্ধানী ধনিক-বণিক গোষ্ঠীর জন্য কোনোভাবেই সহায়ক ছিল না। তাদের সঙ্গে কট্টর পাকিস্তানপন্থি ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির গাঁটছড়া গড়ে ওঠা সহজতর হয়ে যায়। আমলা (সামরিক-বেসামরিক উভয় গোষ্ঠী) মুৎসুদ্দির সুযোগসন্ধানী চরিত্রও এই চক্রান্তে শামিল হয়েছিল। এই গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের উদ্দেশে এক হয়েছিল।

এই দক্ষিণপন্থি গোষ্ঠীর পাশাপাশি হঠকারী বামপন্থি একটি গোষ্ঠী (বিশেষত চৈনিকপন্থি হিসেবে পরিচিত) এবং বাম ভেকধারী হঠকারী জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রী বলে পরিচিত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও পক্ষের কতিপয় সশস্ত্রতাবাদী রাজনীতির ধারক-বাহকদের কর্মকান্ড ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী ডানপন্থি চক্রটিকে সর্বোতভাবে সহায়তা প্রদান করে। তারা তখনো বঙ্গবন্ধুর নামের অপব্যবহার করেছে এবং বর্তমানেও তাঁর নাম ও আদর্শের ধ্বজা সামনে রেখে শোষণ আর শাসনের পাকিস্তানি ধারাকে ফিরিয়ে এনেছে (পঁচাত্তর-পূর্ব যেমন অনেকেই নীরব দর্শক ছিলেন, এখনো তারা ক্ষমতা বলয়ের বাইরের নীরব দর্শক বৈ আর কিছু নয়)।

বঙ্গবন্ধু হত্যার ও ক্ষমতাচ্যুতির সময় রাজনীতির অবস্থাটা কেমন ছিল? তদানীন্তন সময়ের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মাত্রই জানেন যে, রাজনীতিকে, বিশেষত ক্ষমতাসীনদের রাজনীতিতে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা প্রবলভাবে বিরাজমান ছিল। প্রত্যেক জেলায় জেলায় থানায় থানায় ক্ষমতাসীনরা বহুধাবিভক্ত অবস্থায় বিরাজমান ছিল। সাংগঠনিক অবস্থা খুবই দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। বিশেষত, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল মূল দল আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে যাওয়ায়, ছাত্রলীগ-শ্রমিক লীগে বিভক্তি আসায় দলের অবস্থান সাধারণ্যে অনেকটাই প্রশ্নচিহ্নিত হয়ে যায়। জাসদের বিকল্প হিসেবে প্রথমে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট (আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোঃ), সিপিবি) ও পরে বাকশাল গঠন করে এই সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার প্রয়াস নিলেও কার্যত তা রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোতে কোনোরূপ প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের বাইরে ন্যাপ (মোঃ) ও সিপিবি ছিল গণবিচ্ছিন্ন দল। গণমানুষের ভিতরে এদের কোনোই প্রভাব ছিল না। প্রমাণ ন্যাপ-সিপিবির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের আওয়ামী লীগের নৌকায় উঠে নেতার আশ্রয়ে বেঁচে থাকা ও সমৃদ্ধি অর্জন।

সরকার ও দল উভয়টাই চলছিল বঙ্গবন্ধুর একক জনপ্রিয়তায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রাষ্ট্রীয় কাজে (জাতীয়, আন্তর্জাতিক) তাঁর ব্যস্ততার ব্যাপৃতের কারণে সাংগঠনিকভাবে তিনি কোনো সময় দিতে পারেননি। তিনি আস্থায় নিয়ে যাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে দিলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন যোগ্যতার ক্ষেত্রে হ্রস্ব, কেউ কেউ উচ্চাভিলাষী বিধায় দলের অভ্যন্তরে নিজস্ব বলয় সৃষ্টিতে ব্যস্ত। দলের সামগ্রিক সাংগঠনিক ক্ষেত্রে তাদের কর্মতৎপরতা অনুপস্থিত ছিল। ইতিহাসবিদ এ এফ সালাহ্উদ্দীন আহমদ মনে করেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্বলতা, অক্ষমতা, অদূরদর্শিতা, নিজেদের অবস্থান সম্বন্ধে আত্মতুষ্টি এবং অবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ও অসাবধানতার ফলেই শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের জাতীয় বিপর্যয় ঘটে গেল। যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক, বাংলার আপামর জনগণের নয়নমণি, সেই মহান নেতাকে সপরিবারে রাতের অন্ধকারে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হলো এ দেশেরই কিছুসংখ্যক মানুষের হাতে। গোটা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে? কিন্তু এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আমরা কতখানি সোচ্চার হয়েছিলাম আজ সে কথা মনে করলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। ’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণ যে ত্যাগ স্বীকার করেছিল তাদের প্রত্যাশা যেরূপ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির বিপর্যস্ত অবস্থায় জনপ্রত্যাশা পূরণে সেরূপ কর্মসম্পাদন করতে ব্যর্থ হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা তথাকথিত নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিল, যারা সুযোগসন্ধানী ছিল… যে পক্ষ জয়লাভ করবে সে পক্ষে ভিড়ে যাবে, এই মনোভাব নিয়ে… তারা ১৬ ডিসেম্বর বাহিনী হয়ে পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া সম্পদ, ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী যুদ্ধ শরণার্থীদের সম্পদ লুণ্ঠনে ব্যাপৃত হয়ে পড়ল এবং সুযোগ বুঝে জনগণের হতাশাকে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির বিরুদ্ধে উসকে দিতে থাকে। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কাজে লাগিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয় চক্রান্ত হিসেবে উপস্থাপন করতে সচেষ্ট হয়। অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ মনে করেন, ‘একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পরেও পাকিস্তানের প্রতি তাদের আনুগত্য ছিল ষোলআনা। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের সব আদর্শকে ধ্বংস করতে উদ্যত হলো। …শুরু হলো ব্যাপকভাবে ভারতবিদ্বেষী প্রচার। বাংলাদেশের মানুষের সব দুর্গতির জন্য ভারতকে দায়ী করা হলো। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ঢালাওভাবে চরিত্র হননের প্রক্রিয়া শুরু হলো। বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ভারতীয় দালাল বলে আখ্যায়িত করা শুরু হলো। ’ এই হচ্ছে ইতিহাসের যথার্থ ব্যাখ্যা।

বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে ডানপন্থি আর উগ্রপন্থি বামেরা এক হলো। আওয়ামী লীগকে বামে রাখতে একদল অপদার্থ অযোগ্য মস্কোপন্থি লোকেরা তৎপর হলো (এদের অনেকেই পরবর্তীতে জিয়ার খাল খনন কর্মসূচির সমর্থনে এগিয়ে গিয়েছিল)। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত আদর্শ আর বঙ্গবন্ধুর বুকের রক্ত একাকার হয়ে পাকিস্তানের দালাল রাজনীতিক, সামরিক-বেসামরিক আমলা, মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ীদের চক্রান্তের কাছে পরাভূত হতে হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা জিয়া বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকতার পথে নিতে আমাদের সংবিধানে সংবিধানবহির্ভূত পন্থায় পরিবর্তন এনেছিলেন, এরশাদের হাতে সে সাম্প্রদায়িকতার ষোলকলা পূর্ণ হলো। স্বৈর শাসক জিয়া-এরশাদ উভয়ই একই পন্থায় দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নিলেন। এই দুষ্টগ্রহ চক্র বাংলাদেশকে তার ধর্মনিরপেক্ষ শোষণমুক্ত বাঙালি সংস্কৃতি আর জাতীয়তাবাদী পথ থেকে সরিয়ে নেওয়ার সব চক্রান্ত সফল করেছে।

হত্যাকান্ডে যারা জড়িত ছিল রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তারা সবাই দক্ষিণপন্থি। অনেকেই ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধেও অনেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। খন্দকার মোশতাক, শাহ মোয়াজ্জেম, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, কে এম ওবায়দুর রহমান, মোহাম্মদ উল্লাহ, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, কাজী জহিরুল কাইয়ুম, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখের পাশাপাশি জিয়াসহ সামরিক বাহিনীর কুলাঙ্গাররা চেনাজানা। এদের বাইরেও যারা রয়ে গেছে তারা কারা? সংবাদপত্র জগতের লোকেরা (যাদের অনেকেই ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন এবং এখনো পেয়ে যাচ্ছেন), ব্যবসা-বাণিজ্যের লোকেরা (যারা ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন এবং এখনো পেয়ে যাচ্ছেন) তারা কারা? এই নেপথ্যের লোকেরা হর্তাকর্তারা আইয়ুবীয় ধাঁচের রাজনীতিতে আস্থাবান। জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ওদের মূল বাণিজ্য। বাস্তবে এরা মুৎসুদ্দি পুঁজির লোক। এদের চিহ্নিত করতে হবে। আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাস, আমাদের ঐতিহ্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাহন, বাংলাদেশের ভিত্তি। এই ভিত্তিকে ধ্বংস করতেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড, যা আজও অব্যাহত, বঙ্গবন্ধু বন্দনার নামে। এ অবস্থার অবসান চাই।

গণতন্ত্রকে সমুন্নত ও সংহত করতে না পারলে, রাজনীতিকে ধনিক-বণিক-আমলা-মুৎসুদ্দির হাত থেকে বের করে আনতে না পারলে, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান সংকুচিত করে শোষণমুক্তির পথে অগ্রসর হতে না পারলে, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থান রহিত করতে না পারলে, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া সম্পন্ন হবে না। প্রকাশ্য হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। বিচারের সিংহভাগ কার্যকর হয়েছে। কিন্তু নেপথ্যের নায়কদের মুখোশটা আড়ালেই থেকে গেছে। লেবাননের রফিক হারিরির হত্যার পর জাতিসংঘের উদ্যোগে যে তদন্ত কমিশন হয়েছিল, বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে এমনই একটি তদন্ত কমিশন একান্ত কাম্য। খুন ও ষড়যন্ত্রের নেপথ্য নায়কদের পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পথে তাঁর আদর্শকে ধারণ করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে নিয়ে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। তাহলেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পূর্ণতা লাভ করবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর তাঁর সাধের সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব আমরা।

লেখক : সংসদ সদস্য, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা,
পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রতিরোধ যোদ্ধা,
সম্পাদক, মত ও পথ।

শেয়ার করুন