আফগানিস্তান পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের ভাবনা

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। ফাইল ছবি

আফগানিস্তান নিয়ে একটি চমৎকার নাটক অভিনীত হচ্ছে। নাটকটির সূচনা আমেরিকার আগেকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বারা। যবনিকাপাতের ব্যবস্থা করেছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ভদ্রলোক প্রেসিডেন্ট হলে কী হবে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো আফগানিস্তানের মানুষের প্রাণের কোনো দাম যে জো বাইডেনের কাছেও নেই, তা প্রমাণিত হলো। প্রমাণিত হলো সব শিয়ালের এক রা। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ জাতীয় প্রশ্নে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান দলের যতই মতভেদ থাকুক, পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তারা অভিন্ন। আর এই নীতিটি হচ্ছে মার্কিন স্বার্থ ও আধিপত্য রক্ষার জন্য বিশ্বের যেকোনো স্থানে মানুষের জীবনকে কোনো দাম না দেওয়া। ট্রাম্প এটি দেননি। বাইডেনও দিলেন না। একজন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আরেকজন তা কার্যকর করলেন।

মাত্র ১০ দিনের মধ্যে প্রায় সারা আফগানিস্তান দখল করে গত রবিবারের সকালের মধ্যেই তালেবানের বিনা বাধায় কাবুল দখল করে ফেলা, প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির দেশ ছেড়ে পলায়ন কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। কোটি কোটি ডলার খরচ করে যে আফগান রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট বাইডেন যাদের সম্পর্কে গর্ব প্রকাশ করে বলেছিলেন, এই রক্ষী বা নিরাপত্তা বাহিনী এক বছর তালেবানের হামলা সামলাতে পারবে, সেই বীরের দল তালেবানের হামলা এক দিনও সামাল দেওয়া দূরের কথা, তারা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

universel cardiac hospital

মার্কিন তাঁবেদার হামিদ কারজাই মার্কিন সেনার পাহারায় দেশ শাসন করেছেন ১৩ বছর। দ্বিতীয় তাঁবেদার আশরাফ গনি ক্ষমতায় রয়েছেন ছয় বছর। হামিদ কারজাইকে ক্ষমতায় বসানোর সময় বাংলাদেশ থেকে ড. কামাল হোসেনকেও সেখানে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। জানি না, তাঁকেও বাংলাদেশে কারজাই হওয়ার ট্রেনিং দানের জন্য ডেকে নেওয়া হয়েছিল কি না। এটি আমার অনুমান। আমেরিকা ড. কামাল হোসেনকে বাংলাদেশে তাঁবেদার বানাতে চাইলে কাবুলের প্রেসিডেন্ট হাউসের মতো ঢাকার বঙ্গভবনকে মার্কিন সেনা দ্বারা ঘিরে রাখতে হতো, বাংলাদেশ সেই বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পেয়েছে।

যা হোক, যে কথা বলছিলাম। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে আফগানিস্তানে রক্তপাত হচ্ছে। কত লাখ নারী, পুরুষ ও শিশু মারা গেছে তার হিসাব নেই। নজিবুল্লাহর গণতান্ত্রিক শাসনামলে এক নতুন আফগানিস্তান গড়ে উঠতে চলেছিল। মধ্যপ্রাচ্যে কমিউনিজম ঠেকানোর নামে সেই সরকারকে অস্ত্রের মুখে উত্খাত করে যে ধর্মান্ধ তালেবান শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়, তা আফগান জনগণকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয়নি। তারা নারীশিক্ষা বন্ধ করেছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ করেছে। পুরুষকে দাড়ি রাখতে, নারীকে বোরকা পরতে বাধ্য করেছে। দেশে বিচারব্যবস্থা ছিল না। কথায় কথায় শিরশ্ছেদ। আর এই জংলি তালেবান সরকারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য আমেরিকার রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় সরকার কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার ঢেলেছে।

সেই তালেবানের কাছেই আমেরিকা আবার ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। এটি সেনাপসারণ নয়, ক্ষমতা হস্তান্তর। এটি বুঝতে পেরেই তাঁবেদার প্রেসিডেন্ট সবার আগে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এখন তাঁর বদলে হামিদ কারজাই প্রেসিডেন্ট পদে থাকলে পালাতেন। এই কারজাই, গনির মতো ব্যক্তিদেরই নিজেদের সেনা পাহারায় গদিতে বসিয়েছে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব। প্রচার করেছে এঁরা নির্বাচিত সরকারের প্রধান। সেই মিথ্যার ফানুসটা আজ চূড়ান্তভাবে ফেটে গেল।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেছেন, আফগানিস্তানে জনগণের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেখতে পেলে সে সরকারের জন্য বাংলাদেশের দরজা খোলা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অতীতের তালেবান সরকারের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান আফগানিস্তানের অবস্থা দেখে ভবিষ্যতে কী হবে, তা কি বুঝতে পারছেন না? কাবুলের রাস্তা জনশূন্য। আফগানিস্তান থেকে হাজার হাজার নর-নারী দেশত্যাগের জন্য পাগলের মতো প্রতিবেশী পাকিস্তান ও তাজিকিস্তানের দিকে ছুটছে। বাজারে বোরকার দাম ১০ গুণ বেড়ে গেছে। এক রুটির দোকানের মালিক তাঁর দোকানের দরজা এঁটে বসে আছেন। বলেছেন, তাঁর দাড়ি বড় না হওয়া পর্যন্ত আর বের হবেন না। বের হলে নির্ঘাত শিরচ্ছেদ। কাবুল শহরের দেয়ালে নারীদের ছবিসংবলিত বিজ্ঞাপন মুছে ফেলা হচ্ছে। সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষিত ও কর্মজীবী নারীরা আতঙ্কে অস্থির। অনেকে দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন। কাবুল বিমানবন্দর এই পলায়নপর মানুষের ভিড়ে জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। বিমানে যেকোনোভাবে ওঠার জন্য ধাক্কাধাক্কিতে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। অনেকে বলছে, মার্কিন সেনাদের গুলিতে এই মৃত্যু। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, শিশুর দুধ ও খাদ্য দুষ্প্রাপ্য। সব দোকানপাট বন্ধ। করোনার চেয়েও তালেবান আতঙ্কে সারা দেশ স্তব্ধ। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসব জেনেশুনেও কি আশা করেন বিষবৃক্ষ থেকে অমৃত ফল লাভ হবে?

অতীতে আমরা দেখেছি, আফগানিস্তান থেকে হাজার হাজার শরণার্থী পাকিস্তানে প্রবেশ করে দেশের জনজীবন বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। তালেবান অনুসারীরা পাকিস্তানে সন্ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছিল। মসজিদ পর্যন্ত বোমা মেরে ধ্বংস করেছে। শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা বাধিয়েছে। বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এই তালেবানপন্থী জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ ঘটে। শুধু চলে মুক্তবুদ্ধির বুদ্ধিজীবীদের গলা কাটা, রাজনৈতিক সন্ত্রাস। সাড়ে তিন বছর এই জঙ্গিদের সামলাতেই হাসিনা সরকারের সময় কেটেছে। আমরা কি গুলশানের হলি আর্টিজানে ১ জুলাই ২০১৬ সালের সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের কথা ভুলে গেছি? আমরা কি বাংলাদেশে সেই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাই? না, বিপদ আসার আগেই দেশের মানুষকে তালেবানি দুঃশাসন সম্পর্কে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সতর্ক করে দিতে চাই?

ক্ষমতায় বসা ও বিশ্বস্বীকৃতি আদায়ের জন্য আফগান তালেবান এখন এক নতুন মুখোশ ধারণ করছে। তারা এখন বলছে, নারীদের দমনের জন্য তারা আর ব্যবস্থা নেবে না। রাশিয়া ও চীনকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তারা আর এসব দেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাবে না এবং সন্ত্রাসীদের সাহায্য দেবে না, হয়তো ভারতও এই প্রতিশ্রুতি পাবে। কিন্তু পরিণামে এই প্রতিশ্রুতি হবে ব্রিটেনের সঙ্গে হিটলারের মিউনিখ শান্তিচুক্তি করার মতো চুক্তির কালি শুকাতে না শুকাতেই হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করেছিল।

কমিউনিজম ঠেকানোর নামে মার্কিন অর্থে তালেবানের সৃষ্টি। আমেরিকানরাই তালেবানকে আধুনিক যুদ্ধবিদ্যা শিখিয়েছে এবং আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত করেছে। তারপর ক্ষমতায় বসিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢেলেছে তাদের ক্ষমতায় রাখার জন্য। তালেবান যে মানবতার শত্রু এ কথা মার্কিনরা জেনেও ব্যাপারটিকে আমল দেয়নি। আমল দিয়েছে তালেবান বিন লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ার পর। আমেরিকা তালেবানি শাসন উত্খাতের অভিযানে লাখ লাখ আফগান নর-নারীর মৃত্যু ঘটায়, এমনকি বিয়ের আসরে বোমা হামলা করে বর-কনেসহ ৪০০ লোক হত্যা করে। কাবুল শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।

দেশটিতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান দ্বারা নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে জাতীয় সেনাবাহিনী গঠনের জন্য জাতিসংঘকে দায়িত্ব দেওয়ার বদলে সেখানে তাঁবেদার সরকার বসিয়ে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আধিপত্য চালানোর পর আমেরিকা তাদের পুরনো মিত্র তালেবানের কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করছে। আফগানিস্তানের হতভাগ্য জনগণকে আবার হিংস্র হায়েনার মুখে নিক্ষেপ করছে।

আফগানিস্তানের পপি চাষ মাদকদ্রব্য উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। আমেরিকার তাঁবেদার শাসনের সময় এই অবৈধ পপি চাষ দ্বারা লাভবান হয়েছেন আমেরিকা ও পাকিস্তানের জেনারেলরা। আফগান জনগণ হয়েছে বহির্বিশ্বে ভাসমান শরণার্থী। এবার বিদেশি শরণার্থী সম্পর্কে ইউরোপের সব দেশ দ্বার বন্ধ করার নীতি অনুসরণ করতে চাইছে। তালেবান আফগানিস্তান দখল করায় এই শরণার্থী সমস্যা ১০ গুণ বাড়বে। ইউরোপে যেতে গিয়ে আবার কত হাজার শরণার্থী ভূমধ্যসাগরে ডুববে তা কে জানে!

বাংলাদেশেরও সময় থাকতে সতর্ক হওয়া উচিত। আফগানিস্তানে তালেবান রাজত্ব বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য প্রথম দিকে উদারতার ভাব দেখালেও বেশিদিন বিড়ালের নখর লুকিয়ে রাখতে পারবে না। পাকিস্তানে প্রভাব বিস্তারের পর তারা বাংলাদেশের দিকে এগোবে। বাংলাদেশে তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ঘুপটি মেরে আছে জামায়াতি ও হেফাজতিরা। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সবিনয়ে অনুরোধ জানাই, আফগান পরিস্থিতি সম্পর্কে কমপ্লাসেন্ট না হয়ে পরিস্থিতির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখুন।

লন্ডন, মঙ্গলবার, ১৭ আগস্ট ২০২১

শেয়ার করুন