২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার ১৭তম বার্ষিকী আজ শনিবার। আলোচিত এই মামলাটি আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। শিগগির শুনানি হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান শুক্রবার সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসকে জানিয়েছেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার নথিপত্র অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করে পেপার বুক তৈরি করে যাবতীয় প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বিধি অনুসারে শিগগিরই শুনানির পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা ইতিহাসের জঘন্যতম ঘৃণ্য ঘটনা। ইতিমধ্যে এই মামলায় বিচারিক আদালতে দণ্ডিত পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখন এই মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বিচারিক আদালতে এই মামলার রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌসুঁলি সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় এই হামলা চালানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য ও দেশকে অকার্যকর করাই ছিল ওই হামলার উদ্দেশ্য।
আইনজীবী বলেন, ওই হামলায় সমরাস্ত্র আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়। জঙ্গিরা তৎকালীন ক্ষমতাসীন মহলের প্রত্যক্ষ মদদ ও সহায়তায় বর্বরোচিত এ মামলা চালায় শান্তিপ্রিয় আওয়ামী লীগ ও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ সমাবেশের ওপর। তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন ওই ঘটনায় নিহত হন। মারাত্মক আহত হন কয়েকশ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেকে ওই ঘটনার শিকার হয়ে দেহে এর ক্ষত বহন করছেন।
এদিকে পুলিশ সদরদপ্তরের এনসিবি’র এআইজি মহিউল ইসলাম বলেন, ‘তারেক রহমানসহ পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকরের জন্য সম্ভাব্য দেশগুলোর সঙ্গে এনসিবি ঢাকা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। এছাড়া ইন্টারপোলের রেড নোটিশে নাম ওঠাতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার এক বিবৃতিতে আশা করেন, সব আইনি বিধি-বিধান ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যত দ্রুত সম্ভব ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় রায় কার্যকর হবে। এই রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশ থেকে হত্যা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের চির অবসান হবে এবং বাংলাদেশ আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ-শান্তিপূর্ণ আবাসভূমিতে পরিণত হবে।
কী ঘটেছিল সেদিন
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ওই দিনটি ছিল শনিবার। বিকালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের শান্তিপ্রিয় সমাবেশ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। হাজার হাজার মানুষের সমাগম ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের চতুর্দিকে। সমাবেশ শেষে একটি সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হওয়ার কথা। তাই মঞ্চ নির্মাণ না করে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জে চেপে বিকাল ৫টার একটু আগে সমাবেশস্থলে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সমাবেশে অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যের পর শেখ হাসিনা বক্তব্য দিতে শুরু করেন। সময় তখন বিকাল ৫টা ২২ মিনিট। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে শেখ হাসিনার বক্তৃতা শেষের মুহূর্তেই শুরু হলো নারকীয় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা।
বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে লাগল একের পর এক যুদ্ধে ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড। আর প্রাণবন্ত বঙ্গবন্ধু এভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হলো মৃত্যুপুরীতে। শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় ঘাতকরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গ্রেনেড হামলার বীভৎসতায় মুহূর্তেই রক্ত-মাংসের স্তুপে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সমাবেশস্থল। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ট্রাকে অবস্থানরত নেতারা মুহূর্তেই মানবঢাল রচনা করে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে। ওইদিন হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভয়াল গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমান ছাড়াও সেদিন নিহত হন ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, হাসিনা মমতাজ রিনা, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসির উদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের সঙ্গে যুদ্ধ করে ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফসহ আরও কয়েকজন পরাজিত হন।
দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার পর রায়
জঘন্যতম ওই ঘটনায় আনা মামলায় সব পক্ষকে বিদ্যমান সব আইনি সুবিধা দিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-১ রায় ঘোষণা করেন। বিচারিক আদালতের রায়ের পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসংক্রান্ত মামলা এখন হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
বিচারিক আদালতের রায়ে, বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন দুই শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৪ জন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি-বি) সদস্য। এছাড়া রায়ে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন ও অপর ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। তারা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম (সম্প্রতি মারা গেছেন), হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ (মারা গেছেন), জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবু সাইদ, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, হাফেজ আবু তাহের, মো. ইউসুফ ভাট ওরফে মাজেদ বাট, আবদুল মালেক, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ তামিম, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন।
বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। তারা হলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ও আরিফুল ইসলাম আরিফ, জঙ্গিনেতা মুফতি আবদুর রউফ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মুরসালিন, মুত্তাকিন, জাহাঙ্গীর বদর, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. ইকবাল, রাতুল আহমেদ, মাওলানা লিটন, মো. খলিল ও শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল।
এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত ১১ জন হলেন- মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমীন, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার, লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ওরফে ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক আইজিপি শহুদুল হক, সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, ডিএমপির সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, জোট সরকার আমলের তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ও সাবেক পুলিশ সুপার রুহুল আমীন।
এবারে ২১ আগস্টে সীমিত কর্মসূচি
এদিকে এবার করোনা মহামারির প্রকোপের কারণে ২১ আগস্টে সীমিত পরিসরে কর্মসূচি নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নিহতদের স্মরণে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নির্মিত শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করা হবে।
এছাড়াও সকাল সাড়ে ১০টায় ২১ আগস্টের নারকীয় গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদ ও নিহতদের স্মরণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সভায় সভাপতিত্ব করবেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেবেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।