ব্রিটেনের লেবারদলীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার আফগানিস্তান থেকে শিগগির মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের নিন্দা করেছেন। অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তিনি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে ‘ইমবেসাইল’ বলেছেন। আফগানিস্তানে এখন যা ঘটছে সে জন্য তিনি বাইডেনের এই পশ্চাদপসরণকে (retreat) দায়ী করেছেন। আফগানিস্তান থেকে পশ্চিমা দখলদার সেনা সরে যাক এটা সবারই দাবি। কিন্তু আমেরিকা কাবুলের গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতা থেকে উত্খাতের পর দেশটাতে যে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, সেই বিপর্যয় থেকে আফগান জনগণকে উদ্ধার করার কাজ ছেড়ে দিয়ে শিগগির ভিয়েতনামের কায়দায় তারা ‘প্যান্ট খুলে পলায়ন’ করবে এটা অনেকেই আশা করেনি। এই সেনা অপসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় আমেরিকা তার পরম মিত্র ব্রিটেনের সঙ্গেও পরামর্শ করেনি বলে টনি ব্লেয়ার অভিযোগ করেছেন।
টনি ব্লেয়ার যখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তাঁর পরম প্রিয় বন্ধু জর্জ বুশ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। বুশ সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করার আগে টনি ব্লেয়ারকে খবরটা জানানো প্রয়োজন বোধ করেননি। শেষ রাতে তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তাঁর সেক্রেটারি যুদ্ধ শুরু হওয়ার খবরটা দিয়েছিলেন। তখন যদি বুশের অবজ্ঞায় টনি ব্লেয়ার অপমান বোধ না করে থাকেন, এখন ক্ষমতায় না থেকেও কেন সেই একই অবজ্ঞায় অপমান বোধ করছেন, তা তিনিই জানেন।
তবে জো বাইডেনের বিরুদ্ধে ব্লেয়ারের আপত্তিকর ভাষা ব্যবহারে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হবে বলে অনেকেই মনে করেন। আমার ধারণা, ব্লেয়ারের মন্তব্যে লন্ডন-ওয়াশিংটন মৈত্রী সাময়িকভাবে কিছুটা শীতল হবে। তা উষ্ণ হতে দেরি হবে না।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে ভিয়েত কং বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়ে মার্কিন সেনাদের দল বেঁধে পলায়ন, হ্যানয় বিমানবন্দরে পলায়নপর আমেরিকান সেনাদের ভিড়ের সঙ্গে বর্তমানে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার এবং কাবুল এয়ারপোর্টে মার্কিন সেনা ও দেশত্যাগী আফগানদের ভিড় হওয়ার মিল আছে, অমিলও আছে। অমিলটা হচ্ছে ভিয়েতনামের মতো মার্কিন সেনাবাহিনী যুদ্ধ করে তালেবানের হাতে পরাজিত হয়নি। আবার জয়ীও হয়নি। ভিয়েতনামের মতো আফগানিস্তানেও যুদ্ধটা দীর্ঘকালীন এবং মার্কিন সেনারা রণক্লান্ত। মার্কিন অর্থনীতির ওপরও এই বছরের পর বছরের যুদ্ধ করার আর্থিক ব্যয় বিরাট চাপ সৃষ্টি করেছে।
ব্লেয়ার একজন যুদ্ধবাজ অসাধু রাজনীতিক বলে পরিচিত। তিনি আফগানিস্তান থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে বিরক্ত হতে পারেন; কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, আরো বেশিদিন যুদ্ধ চালালে তালেবানের হাতে পরাজিত হয়ে কাবুল থেকে মার্কিন সেনাদের পালাতে হতো। তখন ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সেনাদের পলায়নের দৃশ্যের মিল দেখা যেত। মানুষ দেখতে পেত হ্যানয় এয়ারপোর্টের মতো কাবুল এয়ারপোর্টে পলায়নপর মার্কিন সেনা হেলিকপ্টারের চাকা ধরে ঝুলছে।
বাইডেন যেখানে ভুলটা করেছেন, সেটা হলো কাবুলের সরকার ও আফগান জনগণের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা না করেই অর্থাৎ অধিকৃত আফগানিস্তানের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন না করেই দেশটা ছেড়ে গেছেন। ভিয়েতনামের ভিয়েত কং বাহিনী ছিল জনসমর্থিত মুক্তিবাহিনী। হ্যানয় দখলের পর তারা হত্যাকাণ্ড শুরু করেনি। আর তালেবানরা হচ্ছে একটি মধ্যযুগীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। আফগান জনগণের সার্বিক সমর্থন তাদের প্রতি নেই। মার্কিন সেনা অপসারিত হওয়ার সুযোগ নিয়ে কাবুল দখল করেছে। বিরোধী মতের ও বিপরীত রীতি-নীতির মানুষকে তারা নির্বিবাদে হত্যা করছে।
তালেবানের উত্থানে আফগান জনগণ যে সন্তুষ্টই নয়, বরং ভীত ও আতঙ্কিত, তার প্রমাণ দেশ ত্যাগের জন্য কাবুল এয়ারপোর্টে তাদের ভিড়। এই ভিড়ে পদদলিত হয়ে রোজই মানুষ মারা যাচ্ছে। গত রবিবারেই পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছে সাতজন। তাদের মধ্যে একজন নারীও রয়েছে। তালেবান শাসনে নারীরা লেখাপড়া শিখতে পারবে না, চাকরি করতে পারবে না, সামান্য ভুলে ১০ বেত্রাঘাত খেতে হবে—এই ভয়ে আফগান নারীদের মধ্যেও দেশ ত্যাগের হিড়িক পড়ে গেছে।
বাইডেন এখানেই ভুলটা করেছেন অথবা মার্কিন এস্টাবলিশমেন্টের চাপে এই ভুলটা করতে বাধ্য হয়েছেন। আফগানিস্তানে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে উঠুক, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক—এটা আমেরিকা আগেও চায়নি, এখনো চায় না। তালেবানদের তারাই সৃষ্টি করেছে এবং দ্বিতীয় দফা তাদের ক্ষমতায় বসাতে চাচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তালেবানের হাতে দেশটা তুলে দেওয়ার চুক্তিটা করেন।
এই চুক্তিটা মানতে গিয়ে পর্যায়ক্রমে মার্কিন সেনা অপসারণ না করে এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে আফগান জনগণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে একটা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে দেশটা ছেড়ে দেওয়া দেশটির প্রতি পশ্চিমা শক্তির বিশ্বাসঘাতকতা বলে ইতিহাসে উল্লিখিত হবে। আমেরিকার নির্বুদ্ধিতা অথবা শঠতা আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের সূচনা করতে পারে। আমি যখন এই নিবন্ধটা লিখছি তখন পর্যন্ত (২৩ আগস্ট, সোমবার) কাবুলে সরকার গঠনে তালেবানরা সক্ষম হয়নি। আফগান যুবকরা দেশের পতাকা পরিবর্তনের বিরোধিতা করেছে। জাতীয় পতাকা উড়িয়ে রাজপথে মিছিল করছে। নারী অধিকার কর্মীরা প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস করেছেন। বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, তারা কাবুলসংলগ্ন তিনটি প্রদেশ দখল করে নিয়েছে। দেখেশুনে মনে হয়, আফগানিস্তানের অমারজনীর শেষ হয়নি। সামনে তাদের জন্য আরো কী দুর্যোগ অপেক্ষা করছে তা কে বলবে?
আফগানিস্তানে যদি তালেবান রাজত্ব আবার প্রতিষ্ঠিত হয় তার ঢেউ কি বাংলাদেশ পর্যন্ত পৌঁছবে? আশঙ্কা করা যায় পৌঁছবে। এরই মধ্যে তালেবানপন্থী কিছু মাদরাসাছাত্র তালেবানদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য দেশ ত্যাগ করেছে বলে জানা গেছে। দেশের তালেবানপন্থী দুটি রাজনৈতিক দল নানাভাবে মাথা তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের পুলিশ ও র্যাব সাফল্যের সঙ্গে তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছে।
কিন্তু আশঙ্কা হয়, রাজনীতির ওপরতলায় উগ্র মৌলবাদীরা পরাজিত শক্তি মনে হলেও রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার নিচুতলায় তারা একটা শক্ত ঘাঁটি গেড়ে ঘাপটি মেরে আছে। আফগানিস্তানের তালেবানরা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চাইলে এরা হবে তাদের সহায়ক শক্তি। আমরা যেন আত্মসন্তোষে না ভুগি। করোনার হামলা প্রতিরোধে যখন সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এবং অন্যদিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় নেই, এই সুযোগে তালেবান সমর্থকরা বিএনপি বা এই জাতীয় দল, এমনকি ক্ষমতাসীন দলের ব্যাপারে নানা ইস্যু নিয়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। বরিশালের সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা কোনো তুচ্ছ ঘটনা নয়। এজাতীয় ঘটনা থেকে বড় দাবানল সৃষ্টি করতে পারে।
মনে হতে পারে, দেশে এখন কোনো বিরোধী দল নেই। বিএনপি কোথাও আশ্রয়ের খুঁটি পাচ্ছে না। সম্প্রতি তারা ঘোষণা করেছে, তারা হেফাজতের সঙ্গে আছে। জামায়াতের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে তারা কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। এই দলটি যে কত সুযোগসন্ধানী, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে শাপলা চত্বরে হেফাজতিদের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সময়। খালেদা জিয়া শিগগির হেফাজতিদের সমর্থন দিয়ে বসেছিলেন এবং শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ত্যাগ করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ত্যাগের আলটিমেটাম দিয়েছিলেন।
ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে শেখ হাসিনার জুড়ি নেই। তিনি খালেদা জিয়ার হুমকিতে ভয় পাননি। কামান গোলা নয়, শুধু ওয়াটার ক্যাননের সামনেই হেফাজতি বিপ্লব শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখানেই ভরসা। শেখ হাসিনা এখনো ক্ষমতায় আছেন। সংকট দেখা দিলে তাঁর লৌহমানবীর চেহারা আমরা দেখব—এ বিশ্বাস আমার আছে। তবে সংকট দেখা দেওয়ার আগেই তা নিবারণ করা উচিত। আফগানিস্তানে তালেবান রাজত্ব প্রতিষ্ঠার অর্থ বিপদ আমাদের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে, আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের উঁচু-নিচু সব স্তরে এখনই একটা সজাগ পাহারা গড়ে তোলা দরকার।
লন্ডন, সোমবার, ২৩ আগস্ট ২০২১