বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি ছিল বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ড: মোকতাদির চৌধুরী

মোহাম্মদ সজিবুল হুদা

মোকতাদির চৌধুরী

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি একটি নির্মম, নিষ্ঠুর ও গভীর বেদনাদায়ক অপকর্ম। এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমাদের দেশটাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড শুধু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ছিল না, সেটি ছিল বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ড। যে আদর্শিক ভিত্তির ওপর বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে (বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা)। ১৫ আগস্টের পরে এই ভিত্তিগুলোর ওপর আঘাত করে তারা পুনরায় পাকিস্তানি ধারায় এই দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি তথা সবকিছুতেই প্রভাব ফেলেছিল। এখনও অনেকেই আছেন যারা এই ধারায় বিশ্বাস করেন। তারা এখনও জাতীয় সঙ্গীত গায় না, তাদের পরিচালিত অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উঠানো, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া বিশ্বব্যাপী একটি সার্বজনীন নিয়ম। এই সার্বজনীন নিয়মকক উপেক্ষা করে এখানে এখনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানো হচ্ছে এবং তাদের সাথে আমাদের দহরম-মহরমও আছে, আমরা তাদের সাথে ওঠাবসা করি। এটি নিন্দনীয়, এটি বঙ্গবন্ধুর সময়ে ছিল না। কেননা বঙ্গবন্ধুর সময়ে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকাশ্যে আসার সাহস পায়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তারা প্রকাশ্যে এসেছে।

৩১ আগস্ট (মঙ্গলবার) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬ তম শাহাদত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস ২০২১ উপলক্ষে ‘বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম সূচক’ ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

universel cardiac hospital

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরে ১৬ আগস্ট সকালে মনে হয়েছিল, দেশটা বোধহয় পাকিস্তান হয়ে গেছে। ঐদিন সমস্ত রাজাকাররা মাটির উপর ওঠে এসেছিল। সমস্ত স্বাধীনতা বিরোধীরা মাটির উপর ওঠে এসেছিল। চৈনিকপন্থীরা (যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করছিল) মতিন হক, তোহা এরা সব মাটির উপর ওঠে এসেছিল। মনে হচ্ছিল বাংলাদেশটা তাদের পূর্বপাকিস্তান হয়ে গেছে। সেই অবস্থা থেকে আমরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছি বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। তাঁর নেতৃত্বে আমরা চেষ্টা করছি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য।

তিনি বলেন, ১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধু কারাগারে ছিলেন একথা ঠিক। তখন আওয়ামী মুসলিম লীগ হয়েছে। তবে আওয়ামী মুসলিম লীগ, ছাত্রলীগ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ৫৪’র নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর একটি মূখ্য ভূমিকা ছিল। ৫৪’র নির্বাচনে ২১ দফার ভিত্তিতে প্রথম নৌকা মার্কা নিয়ে যুক্তফ্রন্ট লড়াইয়ে মাঠে ছিল। ৫৬’র শাসনতন্ত্র, সেই শাসনতন্ত্রের সব দিকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু একমত ছিলেন না, তারপরও তিনি কনস্টিটিউয়েন্টসির মেম্বার হিসেবে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে তাঁর যে অবদান, সেটি তিনি রেখেছিলেন।

প্র্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ইস্ট ও ওয়েস্ট পাকিস্তান সর্বক্ষেত্রে সমান সমান প্রতিনিধিত্ব করার যে দাবি ছিল, বঙ্গবন্ধু সেটির বিরোধী ছিলেন। তাঁর গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাম্রাজ্যবাদী জোটের সঙ্গে এক হওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি কী হবে তা ফুটে উঠেছিল।

মোকতাদির চৌধুরী আরও বলেন, ৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে ফুটে উঠেছে। নির্বাচনে আগে যে এলএফও (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক ওর্ডার) হয়েছিল, এটার অধীনে অনেকেই নির্বাচন করার রাজি হলেন না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বললেন আমি এলএফও’র অধীনে হোক আর যাই হোক ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট নীতি যেহেতু আছে সেহেতু আমি নির্বাচনে যাব। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই নির্বাচনকে আমি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করছি। সেটি তিনি করতে পেরেছিলেন।

সাবেক ছাত্রনেতা মোকতাদির চৌধুরী বলেন, ৭১-এর ৭ মার্চের যে বক্তৃতা, এর আগে তিনি সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলার সমাধি সৌধে দাঁড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নাম যে বাংলাদেশ হবে সে কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশ কীভাবে গঠন হবে এবং ওনি কী চান সেটা ২১ ফেব্রুয়ারির বক্তৃতায় তিনি বলেছেন। তিনি যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে যাচ্ছেন সে-সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময় স্পষ্ট কথা বলেছেন। আমি এবং অন্যরা, যারা তখনকার দিনে ছাত্র ছিলাম, আমরা সকলেই জানি- তখনকার আবহাওয়া-ই ছিল এরকম যে, আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে যাচ্ছি এবং ঐ রাষ্ট্রটির নাম হবে বাংলাদেশ। যেটার নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু।

তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশে না ফিরলে আমরা খুব অসহায় অবস্থায় পড়ে যেতাম। আমি জানিনা, বঙ্গবন্ধু না ফিরলে দেশে কী হতো। আমি জানিনা বাংলাদেশ কতটা তার সার্বভৌম ও স্বাধীনতা রক্ষা করে চলতে পারত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ফেরাতে সবচেয়ে বড় কাজটি যেটি হয়েছিল, সেটি হলো- আমাদের সাহায্য সহযোগিতা ও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভারতের সৈন্যদের এদেশ থেকে দ্রুত প্রত্যাহার। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের প্রথম বার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মহীয়সী নারী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেছিলেন ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহার করতে এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে ছিলেন।

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা যে কতটা দূরদর্শিতামূলক কাজ হয়েছিল সেটা নিশ্চয়ই আজকে আমরা অনেকই উপলব্ধি করতে পারি। তারপর তিনি ১৯৭৪ সালে ওআইসি সম্মেলনে গিয়েছিলেন। ওআইসি সম্মেলনে যাওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ নানা রকমের বাধাবিপত্তি ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সকল বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে ওআইসি সম্মেলনে গিয়েছিলেন। এটিও বঙ্গবন্ধুর একটি দূরদর্শিতামূলক সিদ্ধান্ত ছিল।

তিনি বলেন, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে দেশটি সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করছিল,পাকিস্তানের পক্ষে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধু একটি ইফেক্টিভ রিলেশন দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন এবং সেটা সম্ভবও হয়েছিল।

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু কমনওয়েলথে যোগদান করেছিলেন। তার একান্ত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এমনকি পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো বিশ্বসভায় বাংলা ভাষায় তিনি বক্তৃতা করেছিলেন। এগুলো বঙ্গবন্ধুর হিমালয় সমান ব্যক্তিত্বের কারণেই অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব বলেন, অনেকই বলে থাকেন, মুসলিম বিশ্বের সাথে বঙ্গবন্ধুর দূরত্ব ছিল। কিন্তু কথাটি সত্য নয়। আরব বিশ্ব হিসেবে যেটাকে আমরা জানি, সেই অংশে শুধুমাত্র সৌদি আরব ও লিবিয়া ব্যতীত সব দেশই বঙ্গবন্ধুর সময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, , আমাদের যে অবকাঠামোগত স্ট্রাকচার, রাস্তা, সেতু, রেলওয়ে, শিক্ষা ব্যবস্থা সেগুলোও বঙ্গবন্ধু করে গিয়েছেন। আমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ইনস্টিটিউটশনকে বঙ্গবন্ধু পুনরুদ্ধার করেছিলেন। আমাদের ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউটশন বলতে যা বুঝায়, সেন্ট্রাল ব্যাংকিং সিস্টেমসহ অন্যান্য ব্যাংকিং সিস্টেম এসবের কিছু ছিল না, বঙ্গবন্ধুর সময়ে এসব নতুন করে করতে হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করতেন। তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের শুধু ছাত্র ছিলেন বা মুসলিম ছাত্রলীগের একজন এজিটেটর ছিলেন তা কিন্তু নয়, তিনি ইসলামিয়া কলেজের স্টুডেন্ট ইউনিয়নের নির্বাচিত জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন।

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের অর্থনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি সমাজতন্ত্র চাই, তবে সে সমাজতন্ত্র হবে আমার দেশজ সমাজতন্ত্র। সুতরাং তিনি টোটালি আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বাহিরে গিয়ে কোনো কাজ করতে চাইতেন না, যেজন্য তাঁর সময়েই বাংলাদেশ আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মেম্বার হতে পেরেছিল। সকল ইউরোপিয়ান কান্ট্রি ইনক্লুডিং ইউকে বঙ্গবন্ধু সরকারকে ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আর এগুলো বঙ্গবন্ধুর ডাইনামিক লিডারশীপের কারণেই অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল।

শেয়ার করুন