বিচারপতি সঙ্কট নিরসনে রাষ্ট্রপতির নির্দেশের অপেক্ষা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
ফাইল ছবি

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ থেকে শুরু করে বিচারিক (নিম্ন) আদালত- সবখানেই বাড়ছে মামলার সংখ্যা। প্রকট হচ্ছে মামলা জট। কিন্তু বছরের পর বছর মামলা বাড়লেও সে অনুপাতে বাড়েনি বিচারক। ফলে বহু মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ঝুলে আছে।

অবসরে যাওয়া বিচারকদের শূন্যস্থানে সময়মতো নতুন বিচারক নিয়োগ না পাওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও বিচারপতির সঙ্কট হচ্ছে প্রকট। বর্তমানে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে মোট বিচারপতির সংখ্যা পাঁচজন। অথচ একযুগ আগে ২০০৯ সালেও আপিল বিভাগে এ সংখ্যা ছিল ১১ জন।

universel cardiac hospital

বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা বলছেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত থেকে শুরু করে নিম্ন আদালত, সবখানে যে হারে মামলার সংখ্যা বাড়ছে, সে তুলনায় আদালতগুলোতে বিচারকের সংখ্যা বাড়ছে না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। এ অবস্থায় মামলা জট কমাতে ও বিচার কার্যক্রম আরো গতিশীল করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগের বিষয়টিতে এখনই সর্বোচ্চ জোর দেওয়া জরুরি।

মহামারি করোনাভাইরাসের অব্যাহত সংক্রমণ মোকাবিলায় সারা দেশে সরকারঘোষিত লকডাউনের কারণে দেশের সব আদালতে বিচারকাজে গতি কমেছে। এতে ক্রমে কমছে মামলা নিষ্পত্তির হার। অথচ বিগত বছরগুলোতে আদালতে মামলার সংখ্যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। আর এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য নিয়মিত আদালত চালু রাখার দাবি তুলেছেন আইনজীবীরা। একই সঙ্গে মামলার জট কমাতে বহুমুখী উদ্যোগ, বিচারক সংকট ও বিচার-সংক্রান্ত অবকাঠামো উন্নয়নেও তাগিদ দিচ্ছেন বিচার সংশ্লিষ্টরা।

আদালতের কর্মঘণ্টা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান বিচারপতির বরাবর আবেদন করে সুপ্রিম কোর্ট বার। গত ১৯ আগস্ট প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের কাছে করা এক আবেদনে করোনাকালীন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ২০২১ সালের সব অবকাশকালীন/ঐচ্ছিক ছুটি বাতিল ও পরবর্তী বছরগুলোতে ছুটি কমিয়ে আনার অনুরোধ জানানো হয়।

এছাড়া বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির হার ব্যাপক আকারে চালু করারও দাবি আইন জানান বিশেষজ্ঞরা। তবে এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, শুধু রাষ্ট্রপতি নির্দেশ দিলেই আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগের ব্যবস্থা করা যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর দেশের সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময় আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতিসহ মোট বিচারক ছিলেন তিনজন। এরপর গত পাঁচ দশকে পর্যায়ক্রমে আপিল বিভাগে মামলার হার যেমন হ্রাস-বৃ্দ্ধি হয়েছে, তেমনই বিচারপতির সংখ্যা বেড়েছে-কমেছে। এ দীর্ঘ সময় ধরে অবসরে যাওয়ায় আপিল বিভাগে বিচারকের সংখ্যা যে হারে কমেছে, সে হারে নতুন বিচারক নিয়োগ পাননি। ১৯৭৩ সালে আপিল বিভাগে বিচারপতি ছিলেন চারজন, ১৯৭৫ সালে তা বেড়ে হয় পাঁচজন। ১৯৮০ সালেও আপিল বিভাগে ছিলেন পাঁচ বিচারপতি। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে বিচারপতির এ সংখ্যা কখনো চারজন, কখনো-বা পাঁচজনে সীমাবদ্ধ থাকে।

১৯৯৯ সালে এসে আপিল বিভাগে প্রথমবারের মতো বিচারপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ছয়জনে। ২০০৩ সালে তা আরও বেড়ে হয় সাতজন এবং পরের বছর আরও একজন বিচারপতির সংখ্যা বাড়ানো হয়। এর পাঁচবছর পর ২০০৯ সালে আপিল বিভাগে বিচারকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ জনে। যা বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে আপিল বিভাগে সর্বোচ্চ সংখ্যক বিচারপতি থাকার ঘটনা। এরপর আবার বিচারপতির সংখ্যা কমতে থাকে। আর তা কমতে কমতে ২০২১ সালের জুলাই মাসে এসে আবার এ সংখ্যা পাঁচজনে নেমেছে।

বিচারক সংকট ও নিয়োগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির গণমাধ্যমকে বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি সঙ্কট রয়েছে। জরুরিভিত্তিতে বিচারপতি নিয়োগ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

তিনি বলেন, এখন তো বিচারপতি অনেক, মানুষের সমস্যাও বেশি। তবে কাজের লোক কম হলেও খুব ভালো কাজ করা লোক দরকার। অর্থাৎ মামলা নিষ্পত্তির জন্য ভালো বিচারক দরকার। মামলা যে হারে বাড়ছে, বিচারকও কিন্তু কম না, কিন্তু দেখতে হবে ডিসপোজাল কতো।

সাবেক এই অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের অনেক মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। সে কারণেই বলছি, মামলা হ্রাস-বৃদ্ধি বিচারকের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। ফলে দেখে-শুনে ভালো বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।

এখন তো আপিল বিভাগে বিচারকের সংখ্যা কম, বেঞ্চও কম- এ বিষয় কী বলবেন, জানত চাইলে মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, আপিল বিভাগের বিচারপতি ১১ জন ছিল, আবার একসময় তিনজনও ছিল। এখন অনেকে অবসরে চলে গেছেন, তাই বিচারপতির সংখ্যা কমেছে। আশা করি দ্রুতই বিচারক নিয়োগ দিয়ে দেবে সরকার।

দেশের আদালতগুলোতে বিচারকের সংখ্যা কম ও বিচারক নিয়োগ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান গণমাধ্যমকে বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে খুব তাড়াতাড়ি এ (বিচারক) নিয়োগ দেওয়া উচিত। সাম্প্রতিক সময়ে যেহেতু দুটি বেঞ্চে বিচারকাজ চলে আসছিল, তাই দুটো বেঞ্চ দরকার।

‘আর প্রজ্ঞাপন (বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত) আছে ১২ জনের, আমি যতদূর জানি। কাজেই আমার মনে হয় অচিরেই আরো সাতজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া উচিত। এর আগেও পাঁচজন বিচারপতি ছিল আপিল বিভাগে। এ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল ১১ জনে। আবার সাতজন, নয়জন বিচারকও আপিল বিভাগের বিচারিক কাজ পরিচালনা করেছেন। এখন দেখার পালা, নতুন করে কতজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ গণমাধ্যমকে বলেন, বিচারক নিয়োগ না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। আশা করি রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগ দেবেন। আমাদের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ১১ জন পর্যন্ত বিচারক ছিল একসময়। বিভিন্ন সময়ে বিচারপতিরা অবসরে চলে গেছেন। পদগুলো যখন শূন্য হয়, তখন নতুন করে এক মাসের মধ্যে শূন্যস্থান পূরণ করা দরকার। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। রাষ্ট্রপতি কবে বিচারক নিয়োগ দেবেন সেটাই এখন দেখার। সম্ভবত প্রধান বিচারপতিও এটা চান যে, নতুন বিচারপতি নিয়োগ হোক।

তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারপতি থাকলেই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব। কারণ এর আগে দুটো আপিল বেঞ্চ ছিল। এখন একটা বেঞ্চে শুনানি চলছে। যদি কোনো জরুরি বিষয় থাকে সেখানে শুনানি করা হলো, সেক্ষেত্রে আরো একটা বেঞ্চ থাকলে সেখানে অন্য মামলার শুনানি চলতে পারে। বিচারকতো নিয়োগ দিতেই হবে। নিয়োগ না দিলে বিচার বিভাগের কার্যক্রম দুর্বল হয়ে যাবে।

‘এই যে আমরা খুব করে শুধু বলি, ‘মামলা জট মামলা জট’, কিন্তু মামলা জট কমানোর জন্য কাজটা কী, সেটা তো আমরা করছি না। গত এক বছরে বহু মামলা শুনানি হয়েছে। সেখানে আরও বিচারপতি থাকলে আরো বেশি মামলা নিষ্পত্তি হতে পারতো। বিচারক নিয়োগ না দেওয়াটা আমার কাছে সরকারের ব্যর্থতা মনে হয়।’

বিচারক সংকট ও নতুন নিয়োগ নিয়ে সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিচারপতি কমবে আবার নিয়োগ দিতে হবে, এটা নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। আপিল বিভাগে অবশ্যই বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে, নিয়োগটা কখন কবে হচ্ছে, সেটা আমি বলতে পারি না। রাষ্ট্রপতি আমাকে ইন্ডিগেট দিয়ে দিলে, তবেই আমি নিয়োগ প্রসিউড করবো।

শেয়ার করুন