ফেরদৌসী কাদরী : উদ্ভাবনে বিভোর বাংলাদেশের যে বিজ্ঞানী

নিজস্ব প্রতিবেদক

ড. ফেরদৌসী কাদরী
ড. ফেরদৌসী কাদরী। সংগৃহীত ছবি

এশিয়ার নোবেলখ্যাত ম্যাগসেসে পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী। ৩১ আগস্ট এ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৭ সালের এপ্রিল মাসে প্রবর্তিত হয় র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার। এটি প্রবর্তন করেন নিউ ইয়র্ক শহরভিত্তিক রকফেলার ব্রাদার্স ফান্ডের সম্মানিত ট্রাস্টিরা। এই পুরস্কারটির প্রবর্তন করা হয় ফিলিপাইনের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি র‌্যামন ম্যাগসেসেকে স্মরণ করে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, ড. ফেরদৌসী কাদরীর র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর স্বামী ইন্তেকাল করেছেন। ফেরদৌসী কাদরীর স্বামী ড. সাইয়াদ সালেহীন কাদরী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।

universel cardiac hospital

ফেরদৌসী কাদরী আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) ইমিউনোলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের মধ্যে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে যার প্রচেষ্টা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। কলেরা মহামারি থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের টিকা নিয়ে যারা কাজ করেছেন ড. ফেরদৌসী তাদের মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশি প্রতিষেধকবিদ্যা এবং সংক্রামক রোগ গবেষণাকারী বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরীর জন্ম ১৯৫১ সালের ৩১ মার্চ। মা নওশাবা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। মায়ের এমন প্রভাবেই বেড়ে উঠেছেন তিনি—ছোটবেলা থেকেই জানতেন নিজের কিছু একটা করতে হবে। আলাদা কিছু। তবে তা করতে পরিবারকে বাদ দেননি কখনোই।

ফেরদৌসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও আণবিক জীববিদ্যা বিভাগ থেকে ১৯৭৫ সালে বি.এসসি ও ১৯৭৭ সালে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন/প্রতিষেধকবিদ্যা বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। আইসিডিডিআর,বি’র প্রতিষেধকবিদ্যা বিভাগ থেকে পোস্টডক্টোরাল গবেষণা শেষ করার পর, তিনি একই প্রতিষ্ঠানে ১৯৮৮ সালে সহযোগী বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি একই প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী এবং মিউকোসাল ইমিউনোলজি এবং ভ্যাকসিনোলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান।

গবেষণায় অবদান

ফেরদৌসীর প্রধান গবেষণার বিষয় হলো অন্ত্রের রোগ। বিশেষ করে ইমিউনোলজি, জিনোমিক্স, প্রোটোমিক প্রযুক্তি এবং ডায়াগনস্টিকস এবং ভ্যাকসিনে উন্নতি সাধন। তিনি বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের জন্য নতুন ধরণের সস্তা কলেরা টীকা উন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি ব্যয়বহুল ‘ডকোরাল’ টিকার পরিবর্তে ‘শানকল’ নামক একটি টিকা ঢাকায় ব্যবহার করে সফলতা লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে টিকাটি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।

সম্মান ও পুরস্কার

ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভের আগে ২০০৮ সালে ফেরদৌসী বাংলাদশ বিজ্ঞান একাডেমির গোল্ড মেডেল প্রাপ্ত হন। তিনি ২০০২ সালে উন্নয়নশীল দেশে সংক্রামক আন্ত্রিক রোগ গবেষণার জন্য ক্রিস্টোফ মেরিএউক্স পুরস্কার পান।

২০১৩ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমীর বার্ষিক সি. এন. রাও পুরস্কার পান, যেটা তাওস থেকে দেওয়া হয়। জাতিসংঘের প্রস্তাবিত একটি প্রযুক্তি ব্যাংক এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের সাপোর্টিং ব্যবস্থাসমূহ সাংগঠনিকভাবে আরো কর্মক্ষম করে তুলেতে ২০১৪ সালে তাকে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্যানেলের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

উন্নয়নশীল দেশে শিশুদের সংক্রামক রোগ চিহ্নিতকরণ ও বিশ্বব্যাপী এর বিস্তার রোধে প্রাথমিক চিকিৎসা কার্যক্রম এবং টিকাদান কর্মসূচি জোরদারে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ২০২০ সালে তিনি ‘লরিয়েল-ইউনেস্কো উইমেন ইন সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড’ (এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল) লাভ করেন। ২০১৩ সালে অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার পান। এছাড়া ২০২১ সালে, সিঙ্গাপুর ভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়ীকিতে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় তিনি অন্তর্ভুক্ত হন।

শেয়ার করুন