সংসদ সদস্যদের ওপর শেখ হাসিনার ক্ষোভ, দিলেন কঠোর বার্তা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রায় এক বছর পর অনুষ্ঠিত হলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ওই ফোরামে সারাদেশের আট বিভাগের সাংগঠনিক চিত্র তুলে ধরা হয়। যাতে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় নেতাদের পাশপাশি সংসদ সদস্যদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টি উঠে আসে। বৈঠকে মাদারীপুর নিয়ে কেন্দ্রীয় তিন নেতা একে অপরের অভিযোগ করেও বক্তব্য দেন।

সব শুনে সভাপতি শেখ হাসিনা সারাদেশে দ্বন্দ্ব, কোন্দল নিরসন করে তৃণমূল চাঙা করা, আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ, ইশতেহার প্রণয়ন, দ্বন্দ্বে আলোচিত তিন জেলা সম্মেলন আয়োজন, স্যোশাল মিডিয়ার অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ নানা নির্দেশনা দেন।

universel cardiac hospital

বৈঠকে উপস্থিত অর্ধডজন নেতা এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। এছাড়াও নির্বাচনে বিদ্রোহী বা অভিযোগ পেলেই যে কাউকে বহিষ্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রয়োজনে অন্য শাস্তি দেওয়ারও কথা বলেন। জেলা ও উপজেলা কমিটি করার ক্ষেত্রে নিজ নিজ এলাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শ নেওয়ারও নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় নেতারা যেন উপেক্ষিত না হয়।

পাশাপাশি কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের তুলে আনার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা।

দলে সংসদ সদস্যদের ‘খবরদারি’ চলবে না

সাংগঠনিক সম্পাদকদের রিপোর্টে কমপক্ষে ২০-২৫টি জেলায় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে নেতাকর্মীদের দূরত্ব, কোন্দল, উপদল গঠন করার প্রসঙ্গ উঠে আসে। এ নিয়ে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নানা সমীকরণে এমপি মনোনয়ন দেওয়া হয়। তারা দলের মনোনয়নে এমপি হন। এমপি হয়েই দলকে ইচ্ছেমতো পরিচালনায় মরিয়া হয়ে ওঠেন কেউ কেউ। এতে তৃণমূলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের দূরে ঠেলে দেওয়া হয়। আবার সব কর্তৃত্ব নিতে কেউ কেউ উপজেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বনে যান। সবকিছু এমপিদের নিতে হবে কেন? দলের উপর এমপিদের খবরদারি চলবে না। দল চলবে নিজস্ব গতিতে। কমিটি হবে নেতাদের সমন্বয়ে। এমপি দলকে সহযোগিতা করবেন। কোনো বাড়াবাড়ি বরদাস্ত করবো না। কে কোথায় কী করছে, আমার কাছে সব তথ্য আছে।

সম্প্রতি বিভিন্ন জেলায় বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছে। দলীয় সভানেত্রীর কাছে বেশ কিছু অভিযোগও এসেছে। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে বিষয়টি। যে কারণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এমপিদের আলাদাভাবে বলয় তৈরি না করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এখন থেকেই নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মাদারীপুর নিয়ে কেন্দ্রীয় তিন নেতার বাহাস

রিপোর্ট উপস্থাপন করতে গিয়ে ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, মাদারীপুর অনেকজন কেন্দ্রীয় নেতার জেলা। এখানেই কোন্দল বেশি। দলীয় কোন্দল নিরসনে দলীয় প্রধানের হস্তক্ষেপ কামনা করেন মির্জা আজম।

তিনি বলেন, মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগ নবগঠিত উপজেলা ডাসারে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে। এই কমিটিতে স্থানীয় এমপি ও দলের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপের লোক না থাকায় তিনি নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছেন। এসময় দলের প্রচার ও প্রকাশনস সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ কোনো কমিটি দেননি বলে দলীয় প্রধানকে জানান।

বৈঠকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান অভিযোগ করে বলেন, আমি মাদারীপুর সদরের এমপি ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য। সদরে দলের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। আমাকে দাওয়াত করা হয় না।

এসময় আগামী কয়েকদিনের মধ্যে মাদারীপুরে দলের একজন নেতার স্মরণসভায় নাছিমকে প্রধান অতিথি করার কার্ড দলীয় সভানেত্রীকে দেখান শাজাহান খান। একই সঙ্গে জেলা ছাত্রলীগ, যুবলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগসহ বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনে তাকে ভাগ দেওয়া হয় না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

এরপর জবাব দেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, উনি (শাজাহান খান) দলীয় কর্মসূচি পালন করতে চান না। ডাকলে পাওয়া যায় না। উনি একজন দুর্বৃত্ত। উনি সব চান। ছাত্রলীগের সভাপতি বানাতে চান নিজের ছেলেকে। মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি বানাতে চান স্ত্রীকে। অন্য সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বে আত্মীয়-স্বজনকে চান। উনি আওয়ামী লীগকে পারিবারিক লীগ বানাতে চান। এসময় জবাব দিতে কথা বলা শুরু করেন শাজাহান খান। উভয়কে থামিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। নাছিমের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উনি জাসদে ছিলেন। তোমরাই তো দলে নিয়ে এসেছো। আমি চেয়েছিলাম, উনি জাসদ থেকেই আমার সঙ্গে কাজ করুক।

এরপর দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খানকে উদ্দেশ্য করে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আপনি মুরুব্বি। সবাইকে নিয়ে দলটা করবেন। আপনার রাজপথে অনেক অবদান রয়েছে। আমাদের দুঃসময়ে ছিলেন। নৌকা নিয়ে পাঁচবার এমপি হয়েছেন। আপনি কেন ভাগ চাইবেন? সব আপনারই হবে। আপনার করে নিতে হবে। আপনি যদি নাছিম, গোলাপসহ সবাইকে ডাকেন, কেউ আপনাকে ফেলে চলে যেতে পারবে? কেউই উপেক্ষা করতে পারবে না। এসময় প্রধানমন্ত্রী ঠাট্টার ছলে বলেন, আগে আপনাকে (শাজাহান খান) আওয়ামী লীগ হতে হবে। পদে থাকলেই হবে না, আওয়ামী লীগকে ধারণ করতে হবে।

দ্বন্দ্বে আলোচিত তিন জেলা সম্মেলনের তারিখ

বৈঠকে নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস এমপি ও সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল এমপির দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা হয়। দীর্ঘদিন দুই নেতা দুই মেরুতে অবস্থান করছেন। এর আগে সভাপতি আবদুল কুদ্দুস অভিযোগ করেছিলেন, সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল তাকে নাটোর শহরে ঢুকতে দেন না। এছাড়াও শিমুলের সঙ্গে জেলার অন্য এমপিদেরও সর্ম্পক ভালো নয় বলেও বিভাগীয় সাংগঠনিক এসএম কামালের রিপোর্টে উঠে আসে। এমপি শিমুলের দেশের বাইরের (বেগমপাড়া) বাড়ি নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয় বলে একাধিক নেতা জানান। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রিন্স এমপির একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও আলোচনায় আসে। এসব শুনে দলীয় সভাপতি নাটোর ও পাবনা জেলার কোন্দল নিরসনের জন্য দ্রুত সম্মেলন দিতে নিদের্শনা দেন। এসময় রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ১৬ অক্টোবর, নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন আগামী ৬ নভেম্বর ও পাবনায় ৭ নভেম্বর জেলা সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়।

এছাড়াও নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন মেয়াদ উত্তীর্ণ জেলাগুলোকে দ্রত সম্মেলনের তাগিদ দেন শেখ হাসিনা।

জেলাগুলোতে দুই নেতাকে (সভাপতি-সম্পাদক) এক করতে না পারলে তাদের সরিয়ে প্রথম সহ-সভাপতি ও প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককে সামনে নিয়ে এসে হলেও দ্বন্দ্ব নিরসনের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

স্যোশাল মিডিয়ার অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ

সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, দল যত শক্তিশালী হবে, দেশ যত এগিয়ে যাবে, ষড়যন্ত্র তত দানা বাঁধবে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে এই ষড়যন্ত্র আরও বাড়বে। এখনই দেশি-বিদেশি নানা সংস্থা মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণসহ দলীয় নেতাকর্মীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জবাব দিতে হবে। প্রয়োজনে অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এসময় দলের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদকে বিষয়গুলো দেখভালের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

বহিষ্কারে নমনীয়, বিদ্রোহে শাস্তি দেওয়ার নির্দেশ

সভায় বিভিন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে আলোচনা হয়। এসময় চিঠি দিয়ে ক্ষমা চাওয়ায় পাবনার একটি নির্বাচনে দলের প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করা ২০ জন নেতাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা জানান, বিদ্রোহীদের নিয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। যারা অতীতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন বা দলের প্রার্থীদের বিপক্ষে কাজ করেছেন, তাদের দল থেকে একেবারে বহিষ্কার না করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেমন তাকে ভবিষ্যতে তাকে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়া বা দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে না রাখা ইত্যাদি।

বৈঠক সূত্র আরো জানায়, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম দলের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের জেলা সম্মেলন ছাড়া কমিটি ঘোষণার বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, রেওয়াজ অনুযায়ী সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠন করতে হয়। কিন্তু সম্প্রতি দলের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো সম্মেলন ছাড়াই প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কমিটি ঘোষণা করছেন। এই কমিটি নিয়ে অর্থনৈতিক মুখরোচক নানা আলোচনাও শোনা যায়। এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিষয়টি সিরিয়াসভাবে দেখা উচিত।

বৈঠকে সাম্প্রতিক করোনায় ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ডে সন্তোষ প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। তিনি এভাবে মানুষের পাশে থাকার জন্য তাদের ধন্যবাদ দেন।

সভার শুরুতে সূচনা বক্তব্য রাখেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক সচরাচর চার মাস বা দুই মাস পর করতাম। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সেগুলো সময়মতো করতে পারিনি। এখন করোনা কিছুটা কমেছে। এছাড়া আমি গতবার জাতিসংঘের অধিবেশনে যেতে পারিনি। এবার যাচ্ছি। তাই মনে করলাম একটা সভা করি।

প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্যের পরে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, ১৫ আগস্টের নিহতসহ আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতাদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। রীতি অনুযায়ী এরপর সভায় শোকপ্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়।

বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

ওবায়দুল কাদের বলেন, পরবর্তী (দ্বাদশ) নির্বাচনের প্রস্তুতির লক্ষ্যে আমাদের অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করার নির্দেশনা দিয়েছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। দলের বিভিন্ন উপ-কমিটিগুলোর সেমিনারের মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচনের যে ইশতেহার হবে, সেখানে যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে সেগুলো আপডেট করার জন্য উপ-কমিটিগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় আমরা কী কী অন্তর্ভুক্ত করবো তা তুলে ধরা হবে।

শেয়ার করুন