বিএনপির নির্বাচনী ঢোলে কাঠি পড়েছে

আবদুল মান্নান

আবদুল মান্নান
আবদুল মান্নান। ফাইল ছবি

সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালের শেষে বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই উৎসব। হতে পারে তা স্কুল গভর্নিং বোর্ডের নির্বাচন বা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। সংসদ নির্বাচন হলে তো কথাই নেই। কিন্তু ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে সংসদ নির্বাচন জন্ম দিয়েছে এক ভয়াবহ সংস্কৃতির, যার সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব বিএনপি ও তার প্রধান সহযোগী যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর। সন্ত্রাস কাকে বলে এ দেশের মানুষ ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে দেখেছে। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সংবিধানবহির্ভূত উপায়ে নির্বাচন করে সরকার গঠন করা, যার অভিজ্ঞতা তাদের আছে। বিএনপির রাজনীতি অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে আলাদা। তবে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, বিএনপি এ দেশের রাজনীতিতে অন্যতম একটি বড় দল। জামায়াতকে সঙ্গে নিলে তাদের শক্তি ৩ শতাংশ বাড়ে।

আশির দশকে দেশে ছাত্রদের নেতৃত্বে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। এরপর এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল দেশের সব জোটবদ্ধ রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো। রাজনৈতিক জোটগুলো রচনা করেছিল তিন জোটের রূপরেখা, যা ছিল এরশাদ পতনের পর দেশের রাজনীতির জন্য একটি রোডম্যাপ। এর মধ্যে অন্যতম ছিল এরশাদের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচন হতে হবে একটি কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে, যার প্রধান হবেন দেশের প্রধান বিচারপতি। এরশাদবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে তিনি ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করার আগে তিনি তাঁর উপরাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের হাতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ব্যারিস্টার মওদুদ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। পরবর্তী ধাপে ব্যারিস্টার মওদুদ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। সব কিছুই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনেই করা হয়। যেহেতু তখন দেশে রাষ্ট্রপতির শাসনপদ্ধতি বিদ্যমান ছিল, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তাঁর মন্ত্রিসভা (উপদেষ্টা পরিষদ) নিজের পছন্দমতো করে গঠন করেন।

universel cardiac hospital

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নির্বাচন কমিশনও পুনর্গঠন করেন। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। মনোনয়নের ঠিক আগমুহূর্তে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দল থেকে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বাকশালসহ আট দল জোট থেকে বের হয়ে যায় এবং তারা ঘোষণা করে কাস্তে মার্কা নিয়ে পৃথক নির্বাচন করবে। এ সময় আবদুর রাজ্জাক ছিলেন বাকশালের শীর্ষ নেতা। তিনি নিজে কিন্তু আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেন আর কাস্তে মার্কা নিয়ে মোট পাঁচজন বিজয় লাভ করেন। ৪২টি আসনে কাস্তে মার্কার প্রার্থীরা এক থেকে দুই হাজার ভোটে নৌকা মার্কার প্রার্থীদের হারিয়ে দেন। তারা ১০০টির মতো আসনে নৌকার বিপক্ষে প্রার্থী দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ নৌকা মার্কা নিয়ে ৮৮টি আসনে বিজয় লাভ করে। বাকশাল বা অন্যরা কাস্তে মার্কা নিয়ে যদি সেই নির্বাচনে অংশ না নিত, তাহলে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ফল ভিন্ন হতে পারত। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর অনুষ্ঠিত এই অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্ষতি করার জন্য নৌকা মার্কার বিরুদ্ধে যারা নির্বাচন করেছিল, তারা কাজটি ভালো করেনি। অন্যদিকে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে প্রায় ১০০ আসনে আঁতাত করে ১৪০টি আসনে বিজয় লাভ করেছিল আর জামায়াত নিজে ১৮টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। যেখানে জামায়াত কোনো নির্বাচনেই ৩ থেকে ৪ শতাংশের বেশি ভোট পায় না, সেখানে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তারা আঁতাতের ফলে ১২.১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। যে বিএনপি ৩০০টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো প্রার্থী পাচ্ছিল না, তারা সবাইকে অবাক করে দিয়ে ১৯৯১ সালে সরকার গঠন করেছিল। নির্বাচন শেষে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আবার তাঁর আগের কর্মক্ষেত্রে ফিরে গিয়েছিলেন।

মনে করা হয়েছিল, পরবর্তী নির্বাচনগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা হয়নি। কারণ খালেদা জিয়া ক্ষমতার লোভে পড়ে গেছেন। ১৯৯৪ সালে মাগুরায় একটি উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে বিজয়ী করে আনার জন্য তাঁরা এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করেননি। আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ঘরছাড়া থেকে শুরু করে লাগামহীন সন্ত্রাস, বুথ দখল, বিনা বাধায় ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে দেওয়া—সব কিছুই বিএনপি করেছে। তার পরও আওয়ামী লীগ অনেকটা চুপ থেকেছে। একইভাবে ঢাকা-১০ আসনের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। তার পরও আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ ছাড়া তেমন কিছু করেনি। আওয়ামী লীগ বিএনপির এসব কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে বুঝতে পারে, বিএনপির অধীনে কোনো সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ ঘোষণা করে, তারা বিএনপির অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপির অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে তারা সাফ জানিয়ে দেয়। তাদের সঙ্গে সংসদে থাকা অন্য দলগুলোও একই দাবি তোলে এবং সংসদ থেকে মেয়াদপূর্তির আগেই খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন। খালেদা জিয়ার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বেশ চাতুর্যের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে দেন। সবার বাধা উপেক্ষা করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি ডামি প্রার্থী নিয়ে একটি প্রহসনের নির্বাচন করে, যাতে কোনো কেন্দ্রে ৪ থেকে ৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি, যদিও এই সংসদ মাত্র ১২ দিন স্থায়ী ছিল। তবে এই সংসদেই সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। নির্বাচনে বিজয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। তবে সরকার গঠন করতে তাদের সহায়তা নিতে হয় জাসদ ও জাতীয় পার্টির।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের প্রথম সরকার গঠন। প্রশাসনের সর্বত্র বিএনপি আর জামায়াতের কর্মকর্তাদের দিয়ে ঠাসা। এমন বৈরী অবস্থায় দেশ শাসন কত কঠিন, শেখ হাসিনা তা ঠিকই টের পেয়েছিলেন। তার পরও তিনি চেষ্টা করেছেন। সংবিধান থেকে ইনডেমনিটি আইন রহিত করা হয়। জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করে এই আইনটি সংবিধানে সংযোজন করেন। এই আইন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিয়েছিল। এই দফায় শেখ হাসিনা দেশে আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মাত্র ৬২টি আসনে বিজয় লাভ করতে সক্ষম হয়। তারা বুঝতেই পারেনি বিএনপি-জামায়াতের আঁতাত আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমানের চরম পক্ষপাতমূলক আচরণ। নির্বাচন শেষে দক্ষিণ বাংলায় নেমে আসে আওয়ামী লীগ সমর্থক আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ভয়াবহ এক নির্যাতন, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। খালেদা জিয়া এই মেয়াদে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ নানা অজুহাতে বন্ধ করে দেন। তাঁকে সহায়তা করেন তাঁর আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। এই মেয়াদে তিনি আরো একটি কাজ করেন আর তা হচ্ছে বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়িয়ে দেওয়া, যাতে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন বিচারপতি হাসান, যিনি একসময় বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। জিয়ার আমলে তিনি রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। এমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানকে আওয়ামী লীগ কেন মেনে নেবে! এরই মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুল মান্নান খান। সেই মামলায় আবেদনকারীর পক্ষে রায় দেওয়া হয়। এই রায়কে রিভিউ করার জন্য উচ্চ আদালতে ২০০৫ সালে আরেকটি মামলা রুজু করা হয়। সেই মামলার রায়েও বলা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যেহেতু সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী, সুতরাং এই ব্যবস্থা বাতিল করা হলো।

সেই বাতিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে না আনলে নাকি বিএনপি সামনের কোনো নির্বাচনে, মানে ২০২৩ সালের অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অংশ নেবে না। তাহলে তো সংবিধান স্থগিত করতে হয়। কারণ এই ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার আলোচনা অংশে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছেন একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এক মিনিটের জন্যও কোনো অনির্বাচিত সরকারের হাতে দেশের শাসনভার দেওয়া যাবে না। সুতরাং সামনের নির্বাচন বিদ্যমান ব্যবস্থায়ই করতে হবে। আর যদি প্রধানমন্ত্রী মনে করেন তিনি ২০১৪ সালের মতো সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে, যেখানে বিএনপির সদস্যরাও আছেন, একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে পারেন।

বিএনপি আরো বলে থাকে, নির্বাচনের আগে তাদের চেয়ারপারসন, যিনি অর্থ আত্মসাতের আভিযোগে সাজা খাটছেন, তাঁকে মুক্তি দিতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে তো অনেক মামলা অপেক্ষমাণ। আর এসব বিষয় তো আদালতের এখতিয়ার। সেখানে তো সরকারের কোনো কিছু করার নেই।

আসলে বিএনপি সময় এলে নির্বাচনে ঠিকই অংশ নেবে। কারণ তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান, যিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আর আইনের দৃষ্টিতে লন্ডনে পলাতক তাঁর মনোনয়ন বাণিজ্যের জন্য নির্বাচনে তাদের যেতে হবে। লন্ডনে বিলাসী জীবন যাপন করতে হলে অনেক টাকা দরকার। তবে মানুষ আশা করে, ২০১৩ ও ২০১৪ সালের মতো বিএনপি আবার যেন দেশের মানুষের জানমালের ক্ষতি করতে মাঠে না নামে।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

শেয়ার করুন