বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দল নিজেদের একটি গুরুতর ভুল স্বীকার করেছে। এই দলটি হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা একটা অভিনব ব্যাপার। এর আগে আর কোনো রাজনৈতিক দল এ কাজটি করেনি। কিন্তু বিএনপি করেছে। তারা বলেছে, গত সাধারণ নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব ‘হায়ার’ করে তারা ভুল করেছিল। এ ধরনের ‘হায়ার’ করা বা ভাড়া করা নেতৃত্বের অধীনে তারা আর নির্বাচন করবে না। একটি রাজনৈতিক দল হয়ে এই ভুল স্বীকারের জন্য বিএনপিকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি আরো খুশি হয়েছি এ জন্য যে বিএনপি যখন ড. কামাল হোসেনকে নেতা মেনে, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না—এ জাতীয় কিছু নেতাকে দলে টেনে নির্বাচনী ঐক্যজোট গঠন করেছিল, তখন আমিই প্রথম লিখেছিলাম, বিএনপি নেতা ‘হায়ার’ করে নির্বাচনে নেমেছে। এত দিনে আমার ব্যবহার করা ‘হায়ার’ শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ায় আমি অবশ্যই খুশি হয়েছি। আরো খুশি হয়েছি গত নির্বাচনের পরাজয়ে বিএনপির শিক্ষা লাভের জন্য।
বিএনপি বলেছে, ‘হায়ার’ করা নেতার অধীনে তারা আর নির্বাচন করবে না, তাদের নিজেদের নেতা রয়েছে, সেই নেতাদের অধীনেই নির্বাচন করবে। এই নেতা হলেন জেলেবন্দি (জামিনে আবারও মুক্ত) খালেদা জিয়া এবং আরেকজন দণ্ডিত ব্যক্তি খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান। তিনি দীর্ঘকাল বিদেশে। বিদেশে বসে দলের নেতাদের কাছে নির্দেশ পাঠান। বিএনপি এবার তাঁর নেতৃত্বে নির্বাচন করবে। তবে তিনি যদি নির্দেশ দেন বিএনপি সামনের নির্বাচনেও অংশ নেবে না।
একটি ভুল সিদ্ধান্ত শোধরাতে গিয়ে বিএনপি আরো একটি বড় ভুল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারেক রহমান তো এমনিতেই দলের নেতৃত্বে আছেন, তাঁকে ঘোষিতভাবে নির্বাচনের সময় একেবারে লড়াইয়ের সেনাপতি পদে বসিয়ে বিএনপি কি জয়ী হতে পারবে? তারেক একেই তো নানা গুরুতর অপরাধে আদালত কর্তৃক দণ্ডিত আসামি; বিদেশে আত্মগোপন করে না থাকলে তাঁকে এত দিনে জেলের ঘানি টানতে হতো। তাঁর বয়স হয়েছে। কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তি হতে পারেননি। তাঁর না আছে শিক্ষাগত যোগ্যতা, না আছে রাজনৈতিক কোনো প্রজ্ঞা। স্বাধীনতার আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। শুধু বংশানুক্রম দ্বারা কোনো ব্যক্তি যে রাজনৈতিক নেতা হতে পারেন না, তার প্রমাণ ভারতের রাজীব গান্ধীর ছেলে রাহুল গান্ধী। তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেসের আজ ভগ্নদশা।
তবু রাহুল তারেকের মতো বখাটে চরিত্রের নন। অপরাধ করে আদালতে দণ্ডিত হননি। বিদেশে পালাননি। তাঁর মধ্যে এখনো পরিণত বয়সে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তারেক রহমানের বেলায় তা নেই। ছেলে সঞ্জয় গান্ধীর বেলেল্লাপনার জন্য ইন্দিরা গান্ধীর মতো এক বিশ্ববরেণ্য নেত্রীকে নির্বাচনে এক অখ্যাত ব্যক্তির কাছে পরাজিত হয়ে জেলে যেতে হয়েছিল। তেমনি বাংলাদেশে তারেকের সব রকমের দুর্বৃত্তপনাকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে খালেদা জিয়ার দল শুধু নির্বাচনে পরাজিত হয়নি, খালেদা জিয়াও জেলে। মাকে জেলে রেখে তারেক বিদেশে অবৈধ অর্থের জোরে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। মাকে বাঁচানোর জন্য দেশে এসে বুক চিতিয়ে আন্দোলনে নামার, দলকে বাঁচানোর কোনো সাহস ও রাজনৈতিক নৈতিকতা তাঁর মধ্যে নেই।
বিলাতে বসে তারেক রাজনীতি করছেন। অথচ একজন ভালো মানুষ তাঁর সঙ্গে নেই। তিনি যেমন তেমন চরিত্রের সব লোক তাঁর চারপাশে জোগাড় করেছেন। ইতিহাস বিকৃতি ও মিথ্যা কথা বলা ছাড়া তাঁর কাছে রাজনৈতিক মূলধন আর কিছু নেই। এত বছর বিলাতে বাস করে বিলাতের রাজনীতির কিছুমাত্র এটিকেট তিনি শেখেননি। শুনেছি দাউদ ইব্রাহিম এবং মধ্যপ্রাচ্যের দস্যু নামে পরিচিত মির্জা আখন্দ নাকি তাঁর গডফাদার। কথাটা কতটা সত্য জানি না। সত্য হলে বিএনপির কাঁধে চড়ে এই দেশপ্রেমবর্জিত অশুভ ব্যক্তিটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি অঘটন ঘটাতে পারেন তা ভেবে অস্থির হচ্ছি।
আমার ধারণা, খালেদা জিয়া যদি তাঁর বড় ছেলে তারেক লায়েক হওয়ার পর তাঁর দুষ্টবুদ্ধির পাল্লায় না পড়তেন, তাহলে তিনি তাঁকে হাওয়া ভবনে বিকল্প সরকার তথা বাচ্চাই সাক্কোয় রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না দিয়ে ডা. বদরুদ্দোজা, কর্নেল অলি প্রমুখ স্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা সহকর্মীদের পরামর্শে চালিত হতেন এবং বিরোধী দলগুলোর দাবিতে যেমন সংসদীয় প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন, তেমনি আওয়ামী লীগকে আস্থায় নিয়ে দেশে দ্বিদলীয় শাসন মেনে চলতেন। দেশে সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ হতো। জামায়াতের উত্থান সম্ভব হতো না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত থেকে শুরু করে সব উগ্র মৌলবাদী দলের উত্থান যে তারেক রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায়—এ কথা কি বিএনপির নেতাকর্মীরা জানেন না?
বিএনপিকে জিয়াউর রহমানের ক্যান্টনমেন্টকেন্দ্রিক একটি স্বৈরাচারী দল থেকে রাজপথে আন্দোলনে নামা একটি গণতান্ত্রিক দলে পরিণত করেছিলেন খালেদা জিয়া। এই কৃতিত্ব তাঁকে দিতেই হবে। তত দিন তারেক লায়েক হননি। তিনি লায়েক হওয়ার পরই বিএনপিতে ভূতের আছর লাগে। সেই ভূতের আছর থেকে বিএনপি এখনো মুক্ত হতে পারেনি। কেউ চেষ্টাও করেননি সেই আছর থেকে দলটিকে রক্ষা করতে।
বিএনপির নেতাদের জানা উচিত, বর্তমানে তাঁদের জনসমর্থন আছে, কিন্তু ভোট নেই। নির্বাচনে দাঁড়ালে তাদের প্রার্থীরা ভোট পেতে পারেন এবং জয়ীও হতে পারেন। কিন্তু তা হবে প্রোটেস্ট ভোটে। আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির নেতা, কর্মী, এমপি ও মন্ত্রীদের অত্যাচার, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে এই প্রোটেস্ট ভোট দেশে তৈরি হয়েছে। শেখ হাসিনা যদি একটু কঠোর হন এবং দলকে হাইব্রিডমুক্ত করেন, তাহলে এই প্রোটেস্ট ভোট আর থাকবে না। কারণ বিএনপি এখনো জনগণের মনে তাদের দলের জন্য যে আস্থার স্থানটুকু তৈরি করা দরকার তা তৈরি করতে পারেনি। শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে এমন নেতা বাংলাদেশে এখনো তৈরি হয়নি।
গত নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য বিএনপি হামেশা আওয়ামী লীগের কারচুপিকে দোষ দেয়। কারচুপি হয়তো কোথাও কোথাও এক-আধটুকু হয়েছে। তা না হলেও আওয়ামী লীগের জয় ছিল সুনিশ্চিত। এক-আধটু কারচুপি করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ শুধু বদনাম কামিয়েছে এবং বিএনপিকে পরাজয়ের লজ্জা ঢাকার সুযোগ দিয়েছে। বিএনপি এই পরাজয়ের জন্য তাদের ‘হায়ার’ করা নেতা ড. কামাল হোসেনকেও দায়ী করছে। কিন্তু কামাল হোসেন সে জন্য দায়ী নন। দায়ী তারেক রহমানের শয়তানি ও বিশ্বাসঘাতকতা। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে ড. কামাল হোসেনকে আনা হয়েছিল এই আশ্বাস দিয়ে যে তারেক রহমানের বদলে কামাল হোসেনের যৌথ নেতৃত্বে ফ্রন্ট পরিচালিত হবে এবং ফ্রন্ট সিদ্ধান্ত নেবে। এই ফ্রন্ট গঠনের সূচনাতেই তারেক এই সংগঠনের পিঠে ছুরিকাঘাত করেন।
তারেক ড. কামাল হোসেনের মোটা বুদ্ধিকে ভয় করেননি। ভয় করতেন পিতার সহকর্মী ডা. বদরুদ্দোজার বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বকে। সে জন্যই ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে ব্যবহার করে অত্যন্ত নোংরাভাবে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময় ডা. চৌধুরীকে দূরে রাখা হয়। ড. কামাল হোসেন বুদ্ধিমান হলে তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর অপমান থেকে শিক্ষা নিতেন। তা নেননি। পরে তাঁকেও একই অপমানের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তারেক রহমান তাঁর মাথার ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন। ড. কামাল হোসেনকে বশ্য তাঁবেদারের মতো সেসব কথা মানতে হয়েছে।
দীর্ঘকাল পর এসব কথা এখন প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। ড. কামাল হোসেন এখন বহু ব্যবহৃত কমলার খোসা। তাঁর নিজের দল গণফোরাম এখন ‘নামের খসম আজিজ মেছের।’ এ অবস্থায় আগামী নির্বাচনে কী হবে—এই প্রশ্নটা বহুল আলোচিত। বিএনপির সাম্প্রতিক তিন দিনব্যাপী আলোচনা বৈঠকে বলা হয়েছে, বর্তমান সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। এ ছাড়া তারেক রহমানের নির্দেশে তারা কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েছে। বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি মানে ভায়োলেন্স। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দ্বারা সাধারণ মানুষের ক্ষতি করা।
তবে বিএনপির এই তিন দিনের বৈঠকে নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপাশি ঢাকার দৈনিকের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত একটি খবর একটু বিস্ময়কর। খবরটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আবার সক্রিয় হয়েছে। তাদের তৎপরতার কিছু আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে পাকিস্তানের ‘ফ্যাটাল অ্যাট্রাকশন’ এখনো যায়নি। এই অ্যাট্রাকশনের ঘোরে জুলফিকার আলী ভুট্টো, জিয়াউল হক, বেনজির ভুট্টো, নওয়াজ শরিফসহ অনেকেই ঘুরেছেন এবং জীবনপাত করেছেন। পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেটের ব্যাট হাতে একই খেলায় নেমেছেন। দেখা যাক, খেলায় তিনিও টেকেন কি না।
বাংলাদেশে পাকিস্তানের গোয়েন্দাচক্রের তৎপর হওয়ার অর্থই হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার উসকানি, ভারতবিদ্বেষী স্লোগান এবং ধর্ম গেল গেল বলে একই পুরনো অভিযোগ এবং এসবের ভিত্তিতে রাজপথে নিরীহ মানুষ নিধনকারী সন্ত্রাস। রাজনৈতিক আন্দোলন মোকাবেলা করতে হয় রাজনৈতিকভাবে। সন্ত্রাস মোকাবেলা করতে হয় পুলিশ ও র্যাব দ্বারা। অতীতে আওয়ামী লীগ তা করেছে। ভবিষ্যতেও প্রয়োজন দেখা দিলে আওয়ামী লীগ তা করবে। এ কথাটা মনে রেখে বিএনপি তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করলে ভালো করবে। ভবিষ্যতে আবার কোনো রাজনৈতিক পরাজয়ের গ্লানি তাহলে তাদের বহন করতে হবে না।
বিএনপি রাজনীতিতে তাদের একটি ভুলের কথা স্বীকার করেছে। সেটি গত সাধারণ নির্বাচনের সময় ‘হায়ার’ করে নেতা নেওয়ার ভুল। কিন্তু আসল ভুলটি তারা স্বীকার করেনি। তাহলে তারেক রহমানকে এখনো দলের নেতৃত্বে রাখা এবং স্বাধীনতার শত্রু জামায়াত, হেফাজত ইত্যাদি সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে এখনো সম্পর্ক রাখা। আফগানিস্তানে তালেবান রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ায় তারা যদি উৎসাহিত হয়ে থাকে, তাহলে ভুল করবে। আফগানিস্তানে তালেবান রাজত্ব বেশিদিন টিকবে না। আফগান জনগণ এখন আগের মতো অশিক্ষিত নয়। নারীরাও নয়। একটি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পেশাজীবী শ্রেণিও গড়ে উঠেছে। ফলে মোল্লা রাজত্ব ইরানের মতো আধুনিকতার পথ না ধরলে বেশিদিন স্থায়ী হবে না। বাংলাদেশে বিএনপি যদি ‘কাবুলি মেওয়ার’ আশায় থাকে, তাহলে আখেরে কপাল থাপড়াবে।
বিএনপির সামনে বেঁচে থাকার, বেঁচে ওঠার এখন একটিই পথ। সে পথ হলো আংশিক ভুল স্বীকার নয়, দলীয় সামগ্রিক ভুল স্বীকার। এই ভুল স্বীকার হলো জামায়াতের সঙ্গে প্রকাশ্যে, হেফাজতের সঙ্গে গোপনে ঐক্যের রাখি বাঁধা এবং তারেক রহমানকে দলের নেতৃত্বে রাখা। বিএনপি দলের মধ্যে কি এমন কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্ব নেই, যিনি মাথা খাড়া করে দলের অতীতের ভুল স্বীকার করতে পারেন এবং তারেকের অভিশপ্ত নেতৃত্ব অস্বীকার করতে পারেন। আমিও চাই বিএনপি তার অভিশপ্ত অতীত ত্যাগ করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় ফিরে আসুক এবং দেশে দ্বিদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থ ধারা প্রবাহিত হোক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার এর চেয়ে সঠিক পথ আর কিছু নেই।
লন্ডন, রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১