মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ায় বহুমুখী বিপদের শঙ্কার কথা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কথামালার ঊর্ধ্বে উঠে সত্যিকারের গুরুত্ব দিয়ে এ সঙ্কটের সুরাহা করতে উদ্যোগী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বুধবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের আলোচনায় কথা বলছিলেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ফোরসিবলি ডিসপ্লেস মিয়ানমার ন্যাশনালস (রোহিঙ্গা) ক্রাইসিস: ইম্পারেটিভস ফর এ সাস্টেইনেবল সলিউশন’ শীর্ষক এই উচ্চ পর্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠক হয়।
দুর্দশায় পড়া রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ যা যা করছে তার সবই সাময়িক বলে এসময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আবারো মনে করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। রোহিঙ্গারা নিজেরাও তাদের বাড়ি ফিরে যেতে চায় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের বন্ধু আর উন্নয়ন অংশীদারদের প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি, আমাদের এই চেষ্টায় সহযোগিতা করুন।
তিনি বলেন, আমি বার বার বলে আসছি, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। সুতরাং নিরাপদে এবং আত্মমর্যাদার সঙ্গে নিজের দেশ মিয়ানমারেই তাদের ফিরে যেতে হবে। আমাদের সবাইকে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সেজন্য সম্ভব সব কিছু করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট একটি আন্তঃসীমান্ত এবং আঞ্চলিক সমস্যা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরই দায়িত্ব এ মানবিক সঙ্কটের সমাধান করা। গুরুতর এ সঙ্কট বিলম্বিত হলে আমাদের সবার নিরাপত্তাই হুমকির মুখে পড়বে। প্রত্যাবাসনের উদ্যোগে কোনো উন্নতি না হওয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। তাদের অনেকে নানা অপরাধমূলক কাজে জড়াচ্ছে। তাদের অনেকের উগ্রবাদে জড়ানোর ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। আমাদের পুরো অঞ্চলের জন্য এটা একটা হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আলোচনায় বাংলাদেশের প্রধান অংশীদারদের উপস্থিতি উৎসাহ যোগাচ্ছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বিশ্বাস করি, আমাদের মত আপনারাও এ সঙ্কট নিয়ে উদ্বিগ্ন। এখন এই গুরুতর সঙ্কটের সমাধানে দরকার জরুরি উদ্যোগ। এই সঙ্কটের প্রত্যাশিত সমাধানে পৌঁছাতে কথামালার ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের বাস্তব উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, আর রোহিঙ্গারাও সেটাই চায়।
বক্তৃতার শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবারের জাতিসংঘ অধিবেশনে বিশ্ব নেতারা এসেছেন মহামারীর সঙ্কট থেকে মুক্তি আর টেকসই পুনর্গঠনের আশা নিয়ে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলও জরুরি অনেক বিষয়ে সমাধানের আশা নিয়ে এসেছে, যার একটি হল রোহিঙ্গা সঙ্কট।
শেখ হাসিনা বলেন, গত চার বছর আমরা এই আশা ধরে রেখেছি যে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত এই নাগরিকরা নিরাপদে, মর্যাদার সঙ্গে তাদের মাতৃভূমিতে, তাদের নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে। তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আমরা এই বিশ্বসভার ওপর, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর আস্থা রেখেছি। কিন্তু আমাদের আহ্বানে সাড়া মেলেনি। আমাদের আশাও পূরণ হয়নি। আমরা এখন এ সঙ্কটের পঞ্চম বছরে। তারপরও আমরা একটি টেকসই সমাধানের আশা ধরে রেখেছি।
মানবতার স্বার্থে বাংলাদেশ নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের প্রাণ বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেকথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৭ সালে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত এই রোহিঙ্গারা যখন মিয়ানমারের রাখাইন থেকে দলে দলে আসতে শুরু করে। তখন বাংলাদেশের সামনে দুটো পথ ছিল। হয় তাদের প্রাণ বাঁচানো, নয়ত সীমান্ত বন্ধ রেখে তাদের জাতিগত নিধনের শিকার হতে দেওয়া। কিন্তু মানবতার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের প্রাণ বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আটকে থাকায় তারা যাতে সাময়িকভাবে বাংলাদেশে নিরাপদে থাকতে পারে, সম্পদের সীমাবদ্ধতার পরও সেই ব্যবস্থা আমার সরকার নিয়েছে। কিন্তু বিপুল সংখ্যক মানুষের চাপ ওই এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ রেখেছে। আঞ্চলিক পর্যায়ে ভারত ও চীনের মত দেশকে আলোচনায় যুক্ত করা হয়েছে। আসিয়ান যাতে এ বিষয়ে আরও উদ্যোগী হয়, সেই চেষ্টাও করছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে জাতিসংঘেও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখার কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।