ইতিহাসের প্রয়োজনে তাঁর জন্ম। আবার তিনি নিজেই এক ইতিহাস। এই ইতিহাসকন্যা, এই ইতিহাসজননী আজ ৭৫ বছর বয়সে পা রাখলেন। এটা তাঁর হিরণ্ময় জন্ম দিবস। দেশের মানুষ আজ দুই হাত তুলে প্রার্থনারত। তুমি অমিতায়ু হও। হিংস্র শকুনির নখর থেকে যে স্বদেশকে তুমি মুক্ত করেছ, সেই স্বদেশের পুনর্নির্মাণে তুমি সফল হও। সফল হোক তোমার স্বদেশভাবনা। সফল হোক ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ।
হাসিনা-পূর্ব বাংলাদেশের কথা ভাবলেই চিত্রটি পরিষ্কার হয়। বঙ্গবন্ধুসহ সব জাতীয় নেতা নিহত। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে বাংলাদেশে দুঃসহ ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ—গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা পরিত্যক্ত। যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, তা আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে বাংলাদেশে। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের অনুরূপ শাসন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের ওপর।
আওয়ামী লীগ তখন বিপর্যস্ত। নেতৃত্বহীনতার দ্বন্দ্বে জর্জরিত। বিকৃত ইতিহাস তরুণ প্রজন্মকে কানাগলির অন্ধকার সুড়ঙ্গে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই সময় ‘জোয়ান অব আর্কের’ মতো শেখ হাসিনার আবির্ভাব। মাথার ওপরে স্বামী ওয়াজেদ, কোলে এক পুত্র, এক কন্যা। শেখ হাসিনা ইতিহাসের চাকা ঘোরানোর কাজে ব্রতী হলেন। সে এক অসম্ভব যুদ্ধ। হিংস্র ও সশস্ত্র ঘাতক শক্তির বিরুদ্ধে নিরস্ত্র জনগণ নিয়ে অসম যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে শেখ হাসিনা জয়ী হলেন। হলেন জননেত্রী।
বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন সহজ। কিন্তু অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজ পুনর্নির্মাণ সহজ নয়।’ একই কথা অন্যভাবে বলেছেন জওয়াহেরলাল নেহরু। বলেছেন, ‘ইংরেজরা ২০০ বছর আমাদের লুট করেছে, শাসন করেছে, তাতে আমাদের দুঃখ নেই। আমাদের দুঃখ, তারা আমাদের ইতিহাসকে বিকৃত করেছে, আমাদের সমাজকে দূষিত করেছে। বিভক্ত করেছে।’
বাংলাদেশের ইতিহাসে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো। তিনি শুধু জাতির পিতা ও জাতীয় নেতাদের ঘাতক নন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের হত্যাকারী। তিনি যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছেন, সেই বিকৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে সমাজমানসের বহুদিন লাগবে। শেখ হাসিনার যুদ্ধ তাই বহুমুখী। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে ভগ্নস্তূপ থেকে তুলে এনে পুনর্নির্মাণ। দ্বিতীয়ত, সমাজে যে ভয়ানক অবক্ষয় জিয়া সৃষ্টি করে গেছেন, তা থেকে সমাজমানসকে মুক্ত করে তার পুনর্বিন্যাস।
শেখ হাসিনা রাজনৈতিক নেতা, জাদুকর নন। কিন্তু যেন জাদুকরী মন্ত্রে তিনি দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠন করেছেন। দুর্নীতি ও ক্ষমতার ব্যভিচারে পঙ্গু অর্থনীতিকে তিনি জীবনদান করেছেন। গরিবি হটিয়েছেন ও দুর্ভিক্ষ-মঙ্গা এখন অতীতের দুঃস্বপ্ন। দেশে কৃষি উন্নয়ন এতটাই বেড়েছে যে দেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত। শিল্পোন্নয়নের চাকা ঘুরছে দ্রুত। শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার এসেছে। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ আজ শীর্ষস্থানীয় দেশ।
শেখ হাসিনা রাজনৈতিক, প্রাকৃতিক সব রকমের দুর্যোগ মোকাবেলায় জাতিকে সাহসী হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। সেই সাহসের পরীক্ষা হয়েছে চলতি দুই বছরে। বাংলার মানুষ সাহসের সঙ্গে কভিড-১৯ সামলেছে। প্লাবনে হার মানেনি, ডেঙ্গু প্রতিরোধ করেছে। প্লাবিত এলাকার শিশুদের পর্যন্ত দেখা গেছে, বই মাথায় গলা অব্দি পানি ভেঙে স্কুলে যাচ্ছে। এখনো তাদের মুখে হাসি। কণ্ঠে সোনার বাংলার গান।
এক মনীষী বলেছেন, ‘যুদ্ধজয় নির্ভর করে সেনাপতির ওপর। কেবল সৈন্যদলের ওপরে নয়। যদি সেনাপতি একটি ক্ষুদ্র সেনাগোষ্ঠীর মনে সাহস ও মনোবল চাঙ্গা রাখতে পারেন, তাহলে একটি বড় সেনাবাহিনীও তাদের পরাজিত করতে পারে না।’ এই কথাটা শেখ হাসিনার বেলায় শতভাগ সত্য। বাংলাদেশ ১২ মাসে ১৩ সমস্যার দেশ। আজ প্লাবন, তো কাল মহামারি, পরশু খরা ও দুর্ভিক্ষ। মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক দুর্যোগ। হাসিনা-নেতৃত্ব আর কোনো কারণে না হলেও ইতিহাসে এই কারণে উল্লেখ হবে যে তিনি মাল্টিপ্লাস ক্রাইসিস বা বহুমুখী দুর্যোগ মোকাবেলায় জাতির মনে সাহস দিয়েছেন। দুর্যোগ মোকাবেলায় সাহসী হতে শিখিয়েছেন। তাই কভিড, ডেঙ্গু ও প্লাবন—এই তিন শত্রুর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ যে অকুতোভয় সংগ্রাম করেছে, হতাশায় ভেঙে পড়েনি তা উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোকেও বিস্মিত করেছে। রাজনৈতিক দুর্যোগের মুখেও শেখ হাসিনা সমান ধৈর্য ও সাহসের পরিচয় দেখিয়েছেন। জাতিকেও সেই সাহস ও ধৈর্য শিখিয়েছেন। টানা সাড়ে তিন বছর বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাস শুধু অস্ত্রের বলে দমন করেননি, রবার্ট ব্রুশের সাহস ও ধৈর্যের বলে দমন করেছেন।
জননেত্রী, দেশরত্ন, বঙ্গবন্ধু-তনয়া শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্বের বলয় আজ সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সম্প্রসারিত। এক ভারতীয় সাংবাদিক কিছুকাল আগে মন্তব্য করেছেন, ‘একটি ছোট দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও শেখ হাসিনা যে সাহস দেখাচ্ছেন, তাঁর কাছ থেকে ভারতের নেতাদের শেখার রয়েছে। তিনি হিলারি ক্লিনটনের ধমকের কাছে মাথানত করেননি। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কারসাজির মোকাবেলা করেছেন। ভারত ও চীনের বর্তমান শীতল যুদ্ধে বাংলাদেশকে বিস্ময়করভাবে তা থেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছেন।’ কাশ্মীরের সাংবাদিক সোরেস সিং লিখেছেন, ‘আজ শেখ আবদুল্লাহ বেঁচে থাকলে শেখ হাসিনাকেই কাশ্মীর বিরোধ মীমাংসায় মধ্যস্থতার জন্য ডাকতেন।’
হাসিনা একটি তিন অক্ষরের নাম। কিন্তু তাঁর পরিচিতি বিশ্বজুড়ে। বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য দুবাহু প্রসারিত করে লড়াই করছেন। নিজ দেশে নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিজেই আজ একটি ইতিহাস, একটি যুগ। হাসিনা যুগের প্রতীক হয়ে পদ্মার বুকে গড়ে উঠেছে এ যুগের বিস্ময় পদ্মা সেতু। শিগগিরই গড়ে উঠবে মেঘনা সেতুও। পরিকল্পনা আঁটা হচ্ছে ঢাকার অদূরে অত্যন্ত উন্নতমানের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরির। এগুলো হবে ‘হাসিনা যুগের’ একেকটি প্রতীক। এ যুগের বাসিন্দা হতে পারায় পরম গর্ভ অনুভব করি। আজ শেখ হাসিনার শুভ জন্মদিন। এই দিনে তাঁর সুস্বাস্থ্য, নিরাপদ দীর্ঘজীবন কামনা করি তো বটেই, সেই সঙ্গে কামনা করি বাংলাদেশ নামের তরিটির হাল যেন আগামী দিনেও তিনি ধরে থাকেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলাম লেখক