ক্লিনফিড বাস্তবায়নে বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারে অনিশ্চয়তা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদেশি চ্যানেল

পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী শুক্রবার (১ অক্টোবর) থেকে আইন অনুযায়ী বিদেশি চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপনমুক্ত (ক্লিনফিড) সম্প্রচার কার্যকর হয়েছে। ফলে সেদিন থেকেই বাংলাদেশে কোনো বিদেশি চ্যানেল দেখা যাচ্ছে না। ক্যাবল অপারেটররা বলছে, সরকারের এমন সিদ্ধান্তের ফলে সংকটের মুখে পড়ছেন তারা।

অন্যদিকে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থানে সরকার। ক্লিনফিড বাস্তবায়নের তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

universel cardiac hospital

এদিকে গতকাল থেকে বিদেশি চ্যানেল বন্ধ থাকায় দর্শকরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ হওয়ায় চাপের মুখে রয়েছেন ক্যাবল অপারেটররা। তবে বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব টিভি চ্যানেল ওনার্স (অ্যাটকো) বলছে, সরকারের এমন কঠোর সিদ্ধান্তের ফলে ক্লিনফিড বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

জানা গেছে, শুক্রবার থেকে ক্যাবল অপারেটর, ডিটিএইচ সংযোগের মাধ্যমে বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে। আইন অনুযায়ী যাদের মাধ্যমে দর্শক বিদেশি চ্যানেল দেখছেন, তারাই ওই বিদেশি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন ছাড়া সম্প্রচার করবে। ক্লিনফিড হচ্ছে বিদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠানের মধ্যে কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন না দেখানো। কিন্তু বাংলাদেশে সম্প্রচার হওয়া বিদেশি চ্যানেলগুলো সেটি মানে না। অনুষ্ঠানের মধ্যে তারা বিজ্ঞাপন প্রচার করেন। ভারত-পাকিস্তানসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও ক্লিনফিড বা বিজ্ঞাপন ছাড়া বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার হয়। তবে দীর্ঘদিনেও বাংলাদেশে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

ক্যাবল অপারেটর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেসব বিদেশি চ্যানেল বাংলাদেশে সম্প্রচার হয় সেসব চ্যানেল কাস্টমাইজড করে অর্থাৎ বাংলাদেশে তাদের চ্যানেল বিজ্ঞাপনহীন করে সম্প্রচার করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাই ডিজিটালাইজেশনের বিষয়টি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। তবে সরাসরি চ্যানেলগুলোর কাছ থেকে কাস্টমাইজেশনের সুবিধা পাওয়া অনেকটা দুরূহ বলে মনে করছেন তারা। সরকারের তাৎক্ষণিক এমন সিদ্ধান্তের ফলে বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে বলে মনে করছেন তারা।

এ বিষয়ে অ্যাটকোর সদস্য ও ডিবিসি নিউজের চেয়ারম্যান ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ক্যাবল অপারেটর নীতিমালায় ক্লিনফিড দিয়েই কিন্তু বিদেশি চ্যানেল চালানোর কথা। সেভাবে না চালিয়ে তারা এতদিন এভাবেই চালিয়েছেন। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার তাদের সময় দেওয়া হয়েছে। সেই সময়ের মধ্যে তারা সেটি করেননি। সরকার এখন আইন বাস্তবায়ন করার জন্য একটা চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু তারা (ক্যাবল অপারেটর) বরং আইন ভঙ্গ করছেন। তারা আইনও মানছেন না।

তিনি বলেন, ক্যাবল অপারেটররা এখন বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছেন। সবগুলো চ্যানেল তো বন্ধ করার কথা বলা হয়নি। যারা এখানে বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে তাদের সম্প্রচার বন্ধের কথা বলা হয়েছে। যেগুলোর ক্লিনফিড আছে মানে বিজ্ঞাপন নেই সেগুলো তো বন্ধ করার কোনো নির্দেশ নেই। কিন্তু এরা চাপ সৃষ্টির জন্য সব বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরার ক্লিনফিড থাকা সত্ত্বেও তারা তা বন্ধ করে দিয়েছে। এটা চাপ প্রয়োগের একটা কৌশল। আমি মনে করি, এটা আইনসঙ্গত নয়। তবে সরকারের দিক থেকে একটা বিষয় করা উচিত ছিল, সেটা হলো তাদের একটা লিস্ট দেওয়া উচিত ছিল কোনগুলোর ক্লিনফিড আছে, কোনগুলোর নেই। তাহলে হয়তো এরা সবগুলো বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়ার এই সুযোগটি নিতে পারতো না।

ইকবাল সোবহান চৌধুরী আরও বলেন, সব চ্যানেল বন্ধের নির্দেশ তো নয়। সরকার তার আইন বাস্তবায়নের জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছে সে বিষয়ে তারা কঠোর থাকবেন বলে আমি মনি করি। অন্তত আইনভঙ্গ করে যে বিদেশি চ্যানেলগুলো সম্প্রচার হয় সেটা বন্ধ হয়ে যাবে।

ক্যাবল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এসএম আনোয়ার পারভেজ বলেন, বাংলাদেশের এতগুলো ক্যাবল নেটওয়ার্কের সঙ্গে আমাদের তিন থেকে চার লাখ লোকের রুটি-রুজি জড়িত। তাই অন্তত ডিজিটালাইজেশনের বিষয়টি কমপ্লিট না হওয়া পর্যন্ত চ্যানেলগুলো পুনঃসম্প্রচারের জন্য তথ্যমন্ত্রী যেন আমাদের অভিভাবক হিসেবে অনুমতি দেন, এইটুকু আমাদের চাওয়া। বাংলাদেশি ৩৫টা চ্যানেল নিয়ে আমাদের গ্রাহকদের ধরে রাখা টাফ হয়ে যাবে। আমরা যদি গ্রাহকদের থেকে সাবস্ক্রিপশন না পাই তাহলে আমাদের নেটওয়ার্কের ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে পড়বে। তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা তো নেটওয়ার্ক সচল রাখতে পারবো না। আমাদের নেটওয়ার্ক বন্ধ হলে ক্ষতিগ্রস্ত তো আমরা হবো।

ক্লিনফিডের বিষয়ে তাদের অবস্থান জানতে চাইলে আনোয়ার পারভেজ বলেন, সরকার আইন করেছে তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমরা বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ রেখেছি। ক্লিনফিড দেওয়ার মালিক তো আমি না, এটা দেবে যে ব্রডকাস্টার বা যে প্রোভাইড করে। এখন তারা বলে, তারা দিতে পারবে না এই মুহূর্তে। সেজন্য একটি যৌক্তিক সময় নিয়ে মন্ত্রী আমাদের অভিভাবক হিসেবে সেই সময়টুকু দিয়ে এই অচলাবস্থা নিরসনের জন্য দাবি জানাচ্ছি। আমাদের দাবির বিষয়টি আন্দোলন নয়, বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যে সমস্যা তা সমাধান করা। এটা আলোচনার মাধ্যমেই হতে হবে। সেজন্যই আমরা মন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছি। আমি বিশ্বাস করি, অবশ্যই আমাদের সেই সুযোগ দিতে হবে।

এ বিষয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিজ্ঞাপনমুক্ত বা ক্লিনফিড প্রদর্শনের আইন মানা বিদেশি চ্যানেলগুলোর যেমন দায়িত্ব, একইসঙ্গে যারা সেগুলো এখানে সম্প্রচার করে, তাদেরও দায়িত্ব। আমাদের দেশে বছরের পর বছর ধরে আমাদের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বিদেশি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনসহ সম্প্রচার করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশ প্রতি বছর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেই কারণে আমরা যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি, সেটিকে টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন, সম্প্রচার জার্নালিস্ট ফোরামসহ সবাই অভিনন্দন জানিয়েছে। আমরা আশা করবো, বিদেশি চ্যানেলগুলো খুব সহসাই বিজ্ঞাপনমুক্তভাবে বাংলাদেশে ফিড পাঠাবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা বহুবার তাগাদা দিয়েছি এবং শেষ পর্যন্ত যারা এখানে বিদেশি চ্যানেলের প্রতিনিধি তাদের সঙ্গে ক্যাবল অপারেটর ও দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর মালিকদের নিয়ে বৈঠক করে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ১ অক্টোবর থেকে আমরা আইন কার্যকর করবো এবং সে অনুযায়ী আমরা গতকাল থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছি। সরকার কোনো চ্যানেল বন্ধ করেনি। বিদেশি চ্যানেলগুলোর যারা এজেন্ট ও অপারেটর, তারা বিজ্ঞাপনমুক্ত ফিড চালাতে পারছে না বলে সম্প্রচার বন্ধ করেছে। যেসব বিদেশি চ্যানেল বিজ্ঞাপনবিহীনভাবে সম্প্রচার করছে, তাদের চ্যানেল কিন্তু চলছে, চলতে কোনো বাধা নেই।

এদিকে টিভিতে বিদেশি ক্লিনফিড অনুষ্ঠান চালানোর সিদ্ধান্তে তথ্যমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)। শনিবার (২ অক্টোবর) এক বিবৃতিতে ডিইউজে সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেছেন, টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপনমুক্ত বা ক্লিনফিড বিদেশি অনুষ্ঠান সম্প্রচার না করার কারণে দীর্ঘদিন ধরে দেশের অর্থনীতি, শিল্পী, সংস্কৃতি ও মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ১ অক্টোবর থেকে ক্লিনফিড অনুষ্ঠান চালানোর উদ্যোগ কার্যকরের ফলে দেশীয় টেলিভিশন শিল্পের আর্থিক সংকট অনেকটা কমবে। তারা আরও বলেন, টিভিতে বিদেশি অনুষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত সরকারের নয়। এটা ক্যাবল অপারেটরের বা পরিবেশকের।

শেয়ার করুন