বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে ১৭তম বারের মতো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশনে গত ২৫ সেপ্টেম্বর তাঁর ভাষণ দেন। কভিড-১৯ অতিমারির কারণে গত বছর প্রায় সব দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান ভার্চুয়ালি ৭৪তম অধিবেশনে তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। শেখ হাসিনাও তা-ই করেছেন। এদিক দিয়ে ১৮ বার বিশ্বসভায় বক্তব্য দিয়ে শেখ হাসিনা এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সম্ভবত মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের চেয়ে বেশিবার জাতিসংঘে ভাষণ দেন। এই বছরও ৮৩টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান সশরীরে উপস্থিত থেকে জাতিসংঘে ভাষণ দেন। ১৪ তারিখ শুরু হওয়া বিশ্বসভার এই অধিবেশন শেষ হয় গত ২৭ সেপ্টেম্বর।
ঠিক ৪৭ বছর আগে এই বিশ্বসভায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় তাঁর ভাষণটি দিয়েছিলেন। তারিখটি ছিল ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪। এবারও শেখ হাসিনার ভাষণের দিনটি ছিল ২৫ তারিখ। বিষয়টি কাকতালীয় হতে পারে অথবা হতে পারে পূর্বনির্ধারিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দেশটি জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভেটো প্রয়োগ করার কারণে তা হয়ে ওঠেনি। অথচ এই চীনকে জাতিসংঘে প্রবেশ করার জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। কারণ তখন যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে নিয়মিত তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করত। তখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বর্তমান তাইওয়ান হচ্ছে চীন আর তারাই ছিল নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য। বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য পদ দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণ ছিল মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান। তখন চীন পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে ফেরার আগে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম চীনের কাছে আবেদন করেন, তারা যেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভে বিরোধিতা না করে। তত দিন পর্যন্ত ৮৫টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। শেষমেশ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। এর ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিউ ইয়র্কে উপস্থিত হন এবং ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পক্ষে বাংলায় তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন। এটি ছিল জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর প্রথম ও শেষ ভাষণ। কারণ পরের বছর ১৫ই আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘটনাচক্রে তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করার কারণে বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধু যে বছর জাতিসংঘে তাঁর ভাষণটি দেন তখন বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত। এক শিবিরের নেতৃত্বে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর অন্য শিবিরে সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুই শিবিরের মধ্যে চলছে বিশ্বে আধিপত্যবাদ কায়েম করার ঠাণ্ডা লড়াই। এর বাইরে প্রায় ১০০টির ওপর দেশ জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) গঠন করেছিল। এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু, মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসের, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল ব্রোজ টিটো, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ন আর ঘানার প্রেসিডেন্ট কওয়ামে নাক্রুমা। বাংলাদেশ প্রথম সুযোগেই এই আন্দোলনের সদস্য হয়েছিল।
১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে ন্যামের চতুর্থ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হয়ে ৯ সেপ্টেম্বর বক্তব্য দেন। তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত—শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ সেই একই মনোভাব নিয়ে বঙ্গবন্ধু পরের বছর জাতিসংঘে ২৫ সেপ্টেম্বর তাঁর বক্তৃতাটি দেন। এই অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন আলজেরিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ বুত্তাফেলিক, যাঁর সঙ্গে আগের বছর ন্যাম সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু আগেই জানিয়ে দেন যে তিনি তাঁর ভাষণ বাংলায় দেবেন। বুত্তাফেলিক বঙ্গবন্ধুকে বলেন, জাতিসংঘে বাংলাকে তাৎক্ষণিক জাতিসংঘ স্বীকৃত বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করার কোনো ব্যবস্থা নেই। বঙ্গবন্ধু তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। বুত্তাফেলিক বঙ্গবন্ধুকে তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে কমপক্ষে তিনবার অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়ে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ভাষণ বাংলায় দেওয়ার অনুমতি দেন। সেই থেকে বাকিরা বঙ্গবন্ধুর দেখিয়ে দেওয়া পথই অনুসরণ করে আসছেন।
আজকাল যেমন বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো ব্যক্তির বক্তব্য টিভি বা রেডিও বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোনা যায়, ১৯৭৪ সালে তেমন সুযোগ ছিল না। বঙ্গবন্ধু বিশ্বসভায় কী বলেছেন তা জানতে মানুষ অপেক্ষা করেছে বিবিসি বা ভয়েস অব আমেরিকা বা পরদিনের পত্রিকার জন্য। কিছুদিন আগে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বঙ্গবন্ধুকে আখ্যায়িত করেছেন বিশ্ববন্ধু হিসেবে, তার কারণ বঙ্গবন্ধুর জাতিসংঘের দেওয়া ভাষণকে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে শুধু সদ্যঃস্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশার কথা তুলে ধরেননি, তিনি বিশ্বের সব নিপীড়িত মানুষের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, কিভাবে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় ঔপনিবেশিক শোষণের কারণে অনেক দেশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার একাধিক দেশ, যেমন—জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়া ইউরোপীয় শোষকদের শোষণে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে, সে কথা বলতেও তিনি ভোলেননি। বলতে ভোলেননি বিশ্বের অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মানুষ এই শোষণের ফলে হতদরিদ্র হয়ে ক্ষুধাকে নিত্যদিনের সঙ্গী করে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে এমন কোনো আন্তর্জাতিক সভা-সমাবেশ ছিল না, যেখানে তিনি ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতি চরম অবিচারের কথা তুলে ধরেননি। ১৯৭৪ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি সামনে আসেনি। তবে তিনি তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ কিভাবে প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হয়। এই বিপদ মোকাবেলায় তিনি উন্নত দেশগুলোর দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তখন আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের ফলে বিশ্বে তেলের দাম একলাফে ব্যারেলপ্রতি তিন ডলার থেকে ১২ ডলারে উন্নীত হয়েছিল। এর ফলে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। তিনি তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোকে এই বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি। আফ্রিকার অনেক দেশে তখন ভয়াবহ বর্ণবাদের কারণে কালো মানুষ তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। এই বর্ণবাদের জন্মদাতা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাদা মানুষ। বঙ্গবন্ধু মনে করিয়ে দেন এই বর্ণবাদের ফলে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা। বলেছেন এর ফলে জাতিসংঘের মূলনীতির প্রতি চরম অবজ্ঞার কথা। ভারত উপমহাদেশে বারবার শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, অশান্তি শুধু সাধারণ জনগণকে কষ্ট দেয়। বিশ্বের সব দেশে যদি শান্তির নিশ্চয়তা বিধান করা যায়, তাহলেই বিশ্বে শান্তি আসবে। জাতিসংঘের এই কালোত্তীর্ণ ভাষণের মধ্য দিয়ে বিশ্ব দেখল বিশ্বে আরেকজন রাষ্ট্রনায়কের আবির্ভাব।
ঠিক পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কন্যা শেখ হাসিনা গত ২৫ সেপ্টেম্বর একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আরেকটি যুগান্তকারী ভাষণ দিলেন, যা দেশ ও বিদেশের গণমাধ্যমে প্রশংসিত হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস শেখ হাসিনার বক্তৃতার প্রশংসা করতে গিয়ে বাংলাদেশের চোখ-ধাঁধানো উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, এটি সম্ভব হয়েছে একমাত্র শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের কারণে।
২৫ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা আনুমানিক ১৫ মিনিট বক্তৃতা করেন। জাতিসংঘে বক্তৃতার সময়টা পূর্বনির্ধারিত থাকে। বক্তৃতাটি লিখিত এবং তাতে শব্দ ছিল দুই হাজারের মতো। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছয়টি বিষয় তুলে ধরেন, যার প্রায় প্রতিটিই ছিল আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কিত। বলা বাহুল্য, তাঁর ভাষণে সর্বাধিক প্রাধান্য পায় বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যা কভিড-১৯ অতিমারি। তিনি বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য, এই অতিমারিটি সহজে যাওয়ার নয়। এই কারণেই অতীতের মতো আমাদের সবাইকে নিয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সৃজনশীল চিন্তাধারা প্রয়োগ করে এই সর্বগ্রাসী শত্রু মোকাবেলা করতে হবে।’
শেখ হাসিনা বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে আবেদন করেন, সহজে এই মহামারির অবসান ঘটানোর জন্য টিকা যেন সহজলভ্য হয়। তিনি আরো বলেন, টিকাকে জনগণের সম্পদ হিসেবে দেখতে হবে। এটির ওপর কয়েকটি রাষ্ট্রের আধিপত্য বজায় থাকলে তা মানবকল্যাণে অবদান রাখবে না। তা যদি হয়, তাহলে বিশ্ব হয়ে পড়বে একটি টিকা বিভাজিত বিশ্ব। কেউ টিকা পাবে আর কেউ তা থেকে বঞ্চিত হবে। এর ফলে এই অতিমারি কখনো বিলুপ্ত হবে না আর ভয়াবহ বিপদগ্রস্ত হবে বিশ্বের গরিব দেশগুলো। আফ্রিকায় ১২ হাজার কোটি (১.২ বিলিয়ন) মানুষ বাস করে অথচ সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত যে ছয় হাজার কোটি (ছয় বিলিয়ন) টিকা বিলি হয়েছে তার মাত্র ১.২ শতাংশ আফ্রিকা মহাদেশে গেছে। চাদের মতো একাধিক দেশে এখনো কোনো টিকা পৌঁছায়নি।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের মতো যেসব দেশ টিকা উৎপাদনে সক্ষম সেই সব দেশকে প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে টিকা উৎপাদন করতে দেওয়া উচিত।
শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্বের উষ্ণতার মাত্রা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে ভোলেননি। এতে অনেক দেশ ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, চলমান অতিমারির কারণে বিশ্বে বিদ্যার্থীদেরও প্রচণ্ড ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতির কিছুটা পুষিয়ে নিতে তথ্য-প্রযুক্তিকে গরিব দেশগুলোর কাছে সহজলভ্য করার কথা তিনি জোরালোভাবে তুলে ধরেন। তাতে হয়তো ক্ষতির কিছুটা পুষিয়ে যাবে। সব শেষে তিনি বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে অনেকটা হতাশার সঙ্গে বিশ্বসম্প্রদায়ের নির্লিপ্ততার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
গত ২৫ তারিখে জাতিসংঘে দেওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বক্তব্য ৪৭ বছর আগে তাঁর পিতার কথাই শুধু মনে করিয়ে দেয়নি, বরং মনে করিয়ে দিয়েছে তিনি কেন বর্তমান বিশ্বে শুধু একজন নেতাই নন, একজন রাষ্ট্রনায়কও বটে। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান একবার শেখ হাসিনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, বাপের শুধু বেটা হয় না, বেটিও হয়। শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক