মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, হায় হায় কোম্পানির বিষয়ে সরকারের যা করার তাই করছে। প্রতারণাকারীদের সাজা নিশ্চিত করে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি।
সোমবার বিকালে জাতিসংঘ সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে সরকারপ্রধান এই কথা বলেন
শেখ হাসিনা বলেন, মানুষের দুঃসময়ে কিছু প্রতারক তাদের টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করে। যখন এসব ‘হায় হায় কোম্পানি’ তৈরি হয়, আপনারা (গণমাধ্যম) একটু সচেতন করলে মানুষ আর বিপদে পড়ে না। আমরা চেষ্টা করবো তাদের (প্রতারিতদের) টাকা হাতে পৌঁছে দিতে। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মুজিব বর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়হীনদের জন্য সরকার যে ঘর উপহার দিয়েছে, সে সবের কিছু ধসে পড়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পে নয়টি জায়গায় দুর্নীতি পেয়েছি। এতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। তবে দেড় লাখ ঘর দেওয়া হলো। এগুলোর সবগুলোই কি ভেঙে পড়েছে নাকি কেউ ভেঙেছে?
প্রজেক্টরে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু ঘরের ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, এগুলো হাতুড়ি-শাবল দিয়ে ভেঙেছে। আপনারা বিষয়টি একটু ভালো করে দেখেন, খোঁজ নেন। আপনারা এটা খুঁজে বের করলেন না, কারা এটা ভাঙলো। করোনাকালে ঘরগুলো তৈরির ফলে এতো মানুষের কাজের সুযোগ হলো, সেটাও দেখলেন না। আমি কি জানতে পারি কেন আপনারা এটা দেখেননি?
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ৩০০টা ঘর কিছু মানুষ নিজে থেকে গিয়ে হাতুড়ি-শাবল দিয়ে ভেঙে তারপরে মিডিয়ায় সেগুলোর ছবি তুলে ফেলছে। যারা ভেঙেছে, তদন্তে তাদের সবার নাম বের করা হয়েছে।
‘শরণার্থী থাকলে কিছু লোকের লাভ হয়’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অবস্থান তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শরণার্থী থাকলে কিছু লোকের বোধহয় একটু লাভই হয়। তারা এখানে রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু করার বিষয়টি যত বেশি দেখে, প্রত্যাবাসনের দিকে তত নজর দেয় না। অনেক প্রস্তাব আমরা পাই; এটা করা হোক— ওটা করা হোক। সঙ্গে সঙ্গে আমরা বলি—করেন, মিয়ানমারে করেন। আমার এখানে করার তো দরকার নেই। ওদের নিয়ে যান। আমরা এখানে যেটুকু করার আমরা করি।
শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গারা এলে প্রথমে তো আমরা কয়েক মাস নিজেদের অর্থ দিয়েই চালালাম। তারপর আস্তে আস্তে আন্তর্জাতিক সংস্থা এসেছে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত তো আমরা চালিয়েছি। ৪০ হাজার অন্তঃসন্ত্বা নারী ছিল, তাদের ডেলিভারি থেকে শুরু করে সব তো আমরাই করেছি। আমাদের কাছে যখনই আন্তর্জাতিক সংস্থা ওরকম দাবি করে, আমি সোজা বলে দেই, মিয়ানমারে নিয়ে যান। ওখানে ঘর করেন, স্কুল করেন, হাসপাতাল করেন। আমার এখানে করা লাগবে না। এখানে যেটা করার সেটা তো আমি করেই দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমার ধারণা, সবকিছুতেই যেন একটা ব্যবসা। এর মধ্যে কিছু আছে আন্তরিক, কিছু আছে শুনে যায়— সমস্যাটা এখানেই। ১৯৯২ সাল থেকেই তারা (রোহিঙ্গারা) আছে। তিন লাখের মতো ছিল। বাকিরা চলে গেল। পরে এলো ৭-৮ লাখ। ১১ লাখে দাঁড়ালো। আর পাকিস্তানি শরণার্থী তো সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই আছে। তাদের তো আর ফেরতই নিলো না। সেটা আবার সবাই ভুলেও গেছে যে, আমরা আরও এক বিশাল অঙ্কের শারণার্থী পালন করছি। তারা হলো পাকিস্তানের শারণার্থী। পাকিস্তান তাদের নেয়নি, নেবেও না। আর রোহিঙ্গাদের কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।
শেখ হাসিনা বলেন, এখন যেহেতু একটা পরিবর্তন এসেছে আমি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে বলেছি, আপনারা এই সময়ে কেন চাপ দেন না? কারণ এরা আমাদের পুরো পরিবেশটাকেই নষ্ট করেছে। আমরা ছোটবেলায় উখিয়া গিয়েছিলাম, সেখানে ছিল গভীর জঙ্গল, পাহাড়ি পথ ধরে যেতে হয়েছে। চারিদিকে কোথাও বাঘের পায়ের ছাপ, কোথাও হাতির পায়ের ছাপ; আমরা নিজেরাই দেখেছি। আর সেই জায়গা এখন ন্যাড়া মাথা হয়ে গেছে, জঙ্গলের চিহ্ন নেই।
‘প্রথম প্রথম তো একটু খাওয়াতেই হয়’
সরকার কৃষিপণ্য রপ্তানির দিকে নজর দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, বাংলাদেশের আমের স্বাদ একদম আলাদা। এবার আম পাঠালাম। প্রথম প্রথম তো একটু খাওয়াতেই হয়। তারপর আস্তে আস্তে পাঠাতে হয় তাই না…সেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এ বছর আমের মৌসুমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত-পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের আম পাঠিয়েছেন। কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার এবং রপ্তানির দিকটি মাথায় রেখে এই আম পাঠানো হয়।
সাংবাদিক শায়খ সিরাজের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বিশেষ করে কৃষিজাত পণ্য রফতানির দিকে নজর দিচ্ছি। তার জন্য প্রথমেই দরকার ফসল ক্ষেত থেকে তোলার পর তা সংরক্ষণ এবং কার্গোতে তুলে দেওয়া। তার জন্য কার্গো ভিলেজ করতে হবে। যেখানে বিভিন্ন চেম্বার থাকবে। কোন ফসল-কোন তরকারিটা হবে, কোনটা কত ডিগ্রি তাপমাত্রায় ভালো থাকে—এগুলোর কিন্তু আন্তর্জাতিক গবেষণার ফলাফল আছে। আর আমি নিজে নেদারল্যান্ডসে দেখেছি, আমাদের দেশেও এটা করবো। ক্ষেত থেকে কার্গোতে নিয়ে আসার জন্য সেই ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। এখন আমরা কার্গো ভাড়া করে বিদেশে পাঠাই, কিন্তু আমাদের নিজস্ব কয়েকটা কার্গো দরকার।
‘সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন’
রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে জানান প্রধানমন্ত্রী।
সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে। এজন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিট গঠন করবেন, এরপর নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। এরপর নির্বাচন কমিশন গঠন করে পরবর্তী নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী জানান, জনগণের কাছাকাছি থাকার জন্য আওয়ামী লীগে সাংগঠনিক কার্যক্রম চলমান থাকবে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সব সময় দেশ গড়া ও নির্বাচনের প্রস্তুতি, দুটোই একই সাথে চালিয়ে নিয়ে যায়।
নানা ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব জেনেই এ পথে চলছেন তিনি। যতক্ষণ শ্বাস আছে, ততক্ষণ দেশের জন্য কাজ করে যাবেন।