সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণ করতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন ঝিলংজা বনভূমির ৭০০ একর জমির বরাদ্দ স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট।
সেই সঙ্গে বন বিভাগ ও সংসদীয় কমিটির আপত্তি উপেক্ষা করে অকৃষি খাসজমি দেখিয়ে বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে এই বনভূমিতে প্রশিক্ষণ একাডেমি স্থাপনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া কেন অবৈধ, বেআইনি ও বাতিল বলে ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।
আগামী ৪ সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদেশের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন রিটকারী আইনজীবী শেখ একেএম মনিরুজ্জামান কবীর।
এ সংক্রান্ত রিটের শুনানি নিয়ে সোমবার (১১ অক্টোবর) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিঞা ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
আদালতে আজ রিটের পক্ষে শুনানি করেন সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শেখ একেএম মনিরুজ্জামান কবির। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
আইনজীবী শেখ একেএম মনিরুজ্জামান বলেন, এর আগে পত্রিকায় ‘৭০০ একর বনভূমি প্রশাসন একাডেমির জন্য বরাদ্দ’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করে নজরে এনেছিলাম। কিন্তু আদালত আদেশ না দিয়ে রিট আবেদন করতে বলেন। পরে গত ৩ অক্টোবর রিট আবেদন করি। ওই রিটের শুনানি হয় আজ। শুনানি শেষে হাইকোর্ট সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণের লক্ষ্যে কক্সবাজারে মেরিন ড্রাইভের পাশে রক্ষিত বনভূমির ৭০০ একর জায়গা বরাদ্দের আদেশ স্থগিত করেছেন। একইসঙ্গে ওই বরাদ্দের আদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেছেন আদালত।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে রিটটি করেছিলাম যে, যার জমি সে দিচ্ছেন না আরেকজন এসে দিচ্ছে, এই অবস্থায় দেখুন কী করা যায়। আর ২১০০ বিঘা জমি কেন নষ্ট হবে। বন ও প্রাণী দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বন সংরক্ষণ আইনে তো পরিষ্কার বলা আছে বন মন্ত্রণালয়ের যতো সম্পত্তি আছে বনের ভেতরে থাকবে, এখানে বন্যপ্রাণী থাকবে। তাদের চলাচলের পথ পরিষ্কার থাকবে। যাতে তাদের অবাধ বিচরণে কোনোরকম বাধা না আসে। এটা তো আইনে বলা আছে, শুধু তাই না পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি হলেন সাবের হোসেন চৌধুরী তিনি সংসদে বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। আমাদের উপেক্ষা করে ভূমি মন্ত্রণালয় এই জমি বরাদ্দ দিয়েছে। সেসব বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল, ওইসব নিয়ে করা রিটের শুনানিতে বরাদ্দটি তিন মাসের জন্য স্থগিত হলো। এছাড়া চারজন বিবাদীর প্রতি তারা কেন বরাদ্দ দিলেন সেটি কেন বাতিল করা হবে না জানতে চেয়ে শোকজ রুল জারি করেছেন আদালত।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন ঝিলংজা বনভূমির ওই এলাকা প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন। বন বিভাগ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির আপত্তি উপেক্ষা করে গত ৫ সেপ্টেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয় এই জমি বরাদ্দ দিয়েছে। তবে বন বিভাগের দাবি, এই জমি তাদের।
১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকার একে রক্ষিত বন ঘোষণা করে। বন বিভাগ এত বছর ধরে এটি রক্ষণাবেক্ষণ করছে। বিপন্ন এশীয় বন্য হাতিসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বন্য প্রাণীর নিরাপদ বসতি এই ঝিলংজা বনভূমি। বন আইন অনুযায়ী, পাহাড় ও ছড়াসমৃদ্ধ এই বনভূমির ইজারা দেওয়া বা না দেওয়ার এখতিয়ার কেবল বন বিভাগের।
কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই জমি বরাদ্দ নিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এ বনভূমিতে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা নিষেধ। এ কারণে বন বিভাগ থেকে ‘এই ভূমি বন্দোবস্তযোগ্য নয়’ উল্লেখ করে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দপত্রে দেশের অন্যতম জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বনভূমিকে অকৃষি খাসজমি হিসেবে দেখানো হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় বলেছে, বরাদ্দ দেওয়া জমির ৪০০ একর পাহাড় ও ৩০০ একর ছড়া বা ঝরনা। তারা জমির মূল্য ধরেছে ৪ হাজার ৮০৩ কোটি ৬৪ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু একাডেমির জন্য প্রতীকী মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ১ লাখ টাকা।
ভূমি মন্ত্রণালয় এলাকাটিকে অকৃষি খাসজমি দেখালে বন বিভাগ বন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়ে আপত্তি তোলে। তারা জানায়, বন আইন অনুযায়ী ওই জমি বন বিভাগের আওতাধীন ‘রক্ষিত বনভূমি’ হিসেবে চিহ্নিত। ওই জমি বন্দোবস্তযোগ্য নয় বলে একটি চিঠিও ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরকে দেয় বন বিভাগ। ২০০১ সালে দেশের বনভূমির যে তালিকা করা হয়, তাতেও ঝিলংজা মৌজা বনভূমি হিসেবে আছে। সরকারের এই বিভাগ বিসিএস বন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত।
জানতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, ওই বনভূমির মালিক বন বিভাগ। কিন্তু ইজারার জন্য কেউ আমাদের চিঠি দেয়নি। ভূমি মন্ত্রণালয় যে বনভূমি ইজারা দিয়েছে, তাও আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে জানি না।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, দেশের একটি রক্ষিত বন ও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাকে স্থাপনা নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া অবৈধ। আমরা সংসদীয় কমিটি থেকে বরাদ্দ না দিতে চিঠিও দিয়েছিলাম। সরকার যেখানে বেহাত বনভূমি উদ্ধারের চেষ্টা করছে, সেখানে সরকারি সংস্থা যদি অবৈধভাবে বনভূমি ইজারা নেয়, তাহলে বনভূমি রক্ষা হবে কীভাবে?
বন বিভাগের জমি কীভাবে ভূমি মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দিয়েছে জানতে চাইলে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সরকারের এক বিভাগ আরেক বিভাগকে জমি দিয়েছে। এতে সমস্যা কী!
কক্সবাজারভিত্তিক পরিবেশ সংগঠন ইয়েস ওই বনভূমি ইজারা না দেওয়ার দাবি জানিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠি দিয়েছিল। তাতে বলা হয়, সেখানে ৫৮ প্রজাতির বৃক্ষ আছে। এর মধ্যে আছে গর্জন, চাপালিশ, তেলসুর, মোস, কড়ই, বাটনা, ভাদি, বহেরাসহ অনেক দুর্লভ প্রজাতি। এ ছাড়া বন্য প্রাণীর মধ্যে আছে এশীয় বন্য হাতি, বানর, বন্য শূকর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ও পাখি।
সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকার কাছে সাভারে বাংলাদেশ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টার (বিপিএটিসি) আছে। কক্সবাজারে আরেকটি একাডেমি কেন প্রয়োজন জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ২০৪১ সালের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সরকারি কর্মকর্তাদের আরও দক্ষ করে তোলার জন্য এই একাডেমি নির্মাণ করা হবে। এর ধরন কেমন হবে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। তবে মূল উদ্দেশ্য দূরদর্শী নেতৃত্ব তৈরি করা। তিনি জানান, মূল্য পরিশোধ করায় ওই ৭০০ একর জমি ইতিমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য সাভারে বিপিএটিসি আছে। প্রশিক্ষণের জন্য আরও স্থান দরকার হলে সেখানে বহুতল ভবন করা যায় বা তার পরিধি বাড়ানো যায়। তা না করে পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন একটি বনভূমি ধ্বংস করে কেন এ ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে, তা বোধগম্য নয়। এই পরিকল্পনা থেকে অবশ্যই সরে আসা উচিত।