প্রতিবছর ১১ অক্টোবর আন্তর্জাতিকভাবে ‘কন্যাশিশু’ দিবস পালন করা হয়। অনেকটা ঘটা করেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বর্ণাঢ্য স্ট্যাটাস দিয়েই পালন করে থাকেন অনেকে। বিশ্বব্যাপী এই বিশেষ দিবসটি পালন করার গুরুত্ব আসলে কী? শুধুই কি সারা বিশ্বের কন্যাশিশুদের জন্য একটি দিন উৎসর্গ করা মাত্র? বাস্তবতার নিরিখে এই দিবসের গুরুত্ব কতখানি ব্যাপক, তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। সারা বিশ্বেই অনেক কারণে কন্যাশিশুরা আজ বেজায় অবহেলিত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মর্যাদা, ভালোবাসা—বলতে গেলে প্রায় সব দিক থেকেই বঞ্চিত তারা। শুধু যে আমাদের দেশের চিত্র এমন তা নয়। সারা বিশ্বেই কোনো না কোনো জায়গায় প্রতি মুহূর্তে অবহেলার শিকার হচ্ছে আমাদের কোমলমতি কন্যাশিশুরা।
পরিবার ছাড়াও সামাজিকভাবেও তারা নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। মূলত মেয়েদের শিক্ষার অধিকার, পরিপুষ্টি, আইনি সহায়তা ও ন্যায় অধিকার, চিকিৎসা সুবিধা ও বৈষম্য থেকে সুরক্ষা, নারীর বিরুদ্ধে হিংসা ও বলপূর্বক বাল্যবিয়ে বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে এ দিবসের সূচনা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর প্রথম এই দিবস পালন করা হয়। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো প্রতিবছর দিবসটি পালন করে থাকে।
সারা দেশে তথা বিশ্বব্যাপী কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার সঠিক চিত্র বলা বড়ই দুরূহ ব্যাপার। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি চারজন কন্যাশিশুর একজন নানা ধরনের অবহেলা শিকার হয়। সুন্দর শিক্ষাজীবনকে গলা টিপে হত্যা করে গ্রামগঞ্জে নারীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েতে বাধ্য করার শেষ পরিণাম হলো বর্ণনাতীত পারিবারিক সহিংসতা! নিজেদের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকরা ওই কোমলমতি কন্যাশিশুটিকে ‘মা’ হতে বাধ্য করে! এটি নিশ্চয়ই একটি ভয়ংকর মানবাধিকার লঙ্ঘন। পত্রিকা খুললেই আধুনিক কায়দায় নারীকে কেন্দ্র করে নানা রকম অপরাধ সংঘটিত করার চিত্র চোখে পড়ে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুরুষশাসিত এই সমাজব্যবস্থায় নারী তথা কন্যাশিশুকে মাদকাসক্তি, মাদকের ব্যবসা, এমনকি যৌনকর্মে বাধ্য করা হয়। এ যেন অলিখিত এক বৈধ শাসনব্যবস্থা!
উপরোক্ত নেতিবাচক ঘটনার নেপথ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে বলে অনেকেই একমত পোষণ করবেন। যেমন—গণসচেতনতার অভাব, দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরূপ প্রভাব, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাব, সর্বোপরি নারীকে ‘মানুষ’ হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার নোংরা মানসিকতা, এমনকি প্রকৃত শিক্ষা ও বাস্তবায়নের অভাব ইত্যাদি।
অতীতের তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এ ছাড়া তথ্য-প্রযুক্তিতেও মোটামুটি ঈর্ষা-জাগানিয়া অবস্থায় রয়েছে আমাদের দেশ। এখন প্রয়োজন প্রকৃত শিক্ষা অর্জন এবং তার বাস্তবায়ন। সর্বপ্রথম পরিবার থেকেই এর বীজ বপন করতে হবে। পর্যায়ক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষাদানের পাশাপাশি পুরো ক্যাম্পাসে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। সামাজিক কুপ্রথাকে অচিরেই নিপাট করে একটি সুস্থ-সুন্দর আবাসভূমি গড়তে সবার ঐকান্তিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। জাতীয়ভাবে এই দিবস উদযাপন করতে গিয়ে সরকারের পাশাপাশি সমমনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আর যেন একটি কন্যাশিশুও নতুন করে বৈষম্যের শিকার না হয়, নির্যাতনের শিকার না হয়, সারা বিশ্বের সব নারী জাতিকে আমরা যাতে ‘মানুষ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিই; অন্তর থেকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। জাতীয় উন্নয়নের অগ্রণী ভূমিকা রাখছে নারী। ‘কন্যাশিশু’ সমানতালে এগিয়ে যাবে। কন্যাশিশু বোঝা নয়, সম্পদ।
লেখক : কো-অর্ডিনেটর, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ