বছর তিনেক আগের কথা। দু’জন হিন্দু বন্ধু পুজোর সময় এসএমএস করে আমাকে ‘শুভ বিজয়া’ জানিয়েছিলেন। ঈদের দিন আমি আমার অনেক হিন্দু বন্ধুকেও ‘ঈদ মুবারক’ জানিয়ে থাকি। ওরাও ‘ঈদ মুবারক’ জানিয়ে এসএমএস করে। এ ঘটনা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু আমার কাছে একটু অন্যরকম লেগেছিল যখন আমার এক মুসলমান ছাত্রী পূজার সময় এসএমএস করে আমাকে ‘শুভ বিজয়া’ জানায়। এর মধ্য দিয়ে একটি শুভ ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম। ঈদ, পুজো, খ্রিষ্টানদের বড়দিন বা বৌদ্ধদের বৌদ্ধপূর্ণিমা- যে কোনো পার্বণ উপলক্ষ্যে আমরা যদি ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে পরস্পরের জন্য শুভ কামনা করতে পারি, তবে তো জয় হবে মানবতারই।
সব ধর্ম সম্প্রদায়ের আনন্দ যার যার সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতা থেকেই হয়ে থাকে। দুর্গাপূজায় হিন্দুরা যুথবদ্ধভাবে আনন্দ করে, মণ্ডপে মণ্ডপে দল বেঁধে সবাই যায়, এক সঙ্গে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয়। মুসলমানদের ঈদ-আনন্দের ধরনটা আলাদা। মুসলমানদের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে কোনো প্রতীকী স্থাপনা নেই। ফলে পার্থিব ও অপার্থিব আনন্দ ফল্গুধারার মতো ছড়িয়ে থাকে। তবুও অধুনা (কোভিডের দুঃসময়টিকে বাদ দিলে) ঈদ আনন্দে অনেক রূপান্তর ঘটেছে। বিশেষ করে নাগরিক জীবনে। উনিশ বা বিশ শতকের ঢাকার ঈদ উৎসব এখনো টিকে থাকলে পুজোর উৎসবের পাশাপাশি তুলনামূলক বিচার করা যেত।
সে যুগে অনেক আনন্দঘন ঈদ উৎসব পালন করত ঢাকাবাসী। ঈদের দিন জমকালো আনন্দ মিছিল বের হতো। অবশ্য কয়েক বছর ধরে ঢাকায় ঈদ আনন্দ মিছিল হচ্ছে। উনিশ শতকে আর্মানিটোলা, ধূপখোলা বা রমনার মাঠে ঈদ উৎসবের অংশ হিসাবে কত্থক নাচের আয়োজন হতো। কোথাও হতো হিজড়া নাচ। ঘুড়ি ওড়ানো আর নৌকাবাইচের আয়োজন হতো। আর এসব অনুষ্ঠানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষও আনন্দ ভাগ করে নিত। আমাদের ছেলেবেলার কথা স্মরণে আনতে পারি; নারায়ণগঞ্জের বন্দরে অনেক হিন্দু পরিবারের বাস ছিল। এদের উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন পর্যায়ে ভারত চলে গেছেন।
এসব বাড়িতে আমার বোনদের বান্ধবী অনেক দিদি ছিলেন। আদর-স্নেহ পেয়ে তাদের দূর সম্পর্কের মনে হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা ছোটরা যেমন কর গুণে ঈদের অপেক্ষা করতাম, একইভাবে দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা আর সরস্বতী পূজার জন্যও দিন গুনতাম। মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে প্রতিমা দেখা, ঢাকির জাদুকরী হাতে মনমাতানো ঢাকের বাদ্যে মাতোয়ারা হওয়া আর প্রসাদ খাওয়ার লোভ তো ছিলই।
শুধু ঈদ নয়, মহররমের মিছিলেও ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ ছিল। ইরাক-ইরানসহ অনেক আরব দেশে শিয়া-সুন্নির মধ্যকার দ্বন্দ্ব হানাহানির পর্যায়ে চলে যায়। এই তো দুদিন আগে আফগানিস্তানে শিয়া মসজিদে বোমা হামলা করে অনেককে আহত-নিহত করা হয়েছে। এদিক থেকে বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। আঠারো শতক থেকে ঢাকায় মহররম পালিত হচ্ছে। শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে সুন্নি মুসলমানের অংশগ্রহণ এ দেশে স্বাভাবিকই ছিল। আঠারো-উনিশ শতকের নথিতে দেখা যায়, একটি সাংস্কৃতিক প্রণোদনা নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে শরিক হতো মহররমের মিছিলে। বিশ্বাস ছিল কারবালার স্মৃতিতে দুলদুলের প্রতীক ঘোড়ার পায়ে দুধ ঢেলে মনোবাঞ্ছা করলে তা পূরণ হয়। অনেক হিন্দুও ইচ্ছাপূরণের আশায় দুলদুলের পায়ে দুধ ঢালত।
মুসলমান পিরের সমাধিতে হিন্দুর যাওয়া, প্রার্থনা করা এ দেশে একটি সাধারণ চিত্র। গ্রাম-গঞ্জের নানা জায়গায় এখনো ভাদ্রের শেষ বৃহস্পতিবার নদীতে কলার ভেলায় রঙিন কাগজের ঘর বানিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাসানো হয়। এই ‘ভেলা ভাসানো’ উৎসবে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে। সুন্দরবনের সঙ্গে জীবিকা জড়িয়ে আছে এমন মুসলমান বাওয়ালি, কাঠুরে বা জেলেরা বনের রক্ষাকর্ত্রী দেবী কল্পনায় বনবিবি আর ব্যাঘ্র দেবতা গাজীর নাম জপ করে। অন্যদিকে হিন্দু বাওয়ালি, কাঠুরে ও জেলে একই অধিকর্ত্রী দেবী হিসাবে বনদুর্গা আর ব্যাঘ্র দেবতা হিসাবে নাম জপ করে দক্ষিণ রায়ের।
এসব বাস্তবতা এ দেশের দীর্ঘকাল ধরে লালিত সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা ধর্মীয় সম্প্রীতির কথাই প্রকাশ করছে। সমাজ, ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বের ছাত্র হিসাবে আমি আমার লেখায় বহুবার বলার চেষ্টা করেছি যে, ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে এ দেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অপচ্ছায়া খুব স্বাচ্ছন্দ্যে ডানা মেলতে পারবে না। এ দেশের সাধারণ মানুষের মানসিক গড়ন সাম্প্রদায়িকতার ভেদবুদ্ধিকে সমর্থন করে না। তারপরও এ সত্য মানতে হবে যে, অন্ধকারের জীব-যারা ধর্মকে আধ্যাত্মিকতার গাম্ভীর্য আর সৌন্দর্যে না দেখে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা লাভের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে চায়, তারা কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর চেষ্টা করে।
অন্যদল অতটা বুঝে নয়, বরং সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা ও কূপমূণ্ডকতার কারণে ধার্মিক না হয়ে এক ধরনের ধর্মান্ধ হয়ে যায়। ধর্মচর্চার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন না করে অনালোকিত এবং সীমাবদ্ধ জ্ঞানের ধর্মনেতার বয়ান শুনে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়। প্রথম শ্রেণির ধর্ম-বণিকদের চেনা যায়, ফলে এদের প্রতিহত করাও সম্ভব; কিন্তু অতি ধীরে হলেও দ্বিতীয় শ্রেণির সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মানুষের পক্ষে সমাজ কলুষিত করার ক্ষমতা বেশি বলে আমি মনে করি। প্রথমে তারা নিজ পরিবারকে প্রভাবিত করে, পরে প্রতিবেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।
আমি গবেষণার কাজে বেশ কিছুকাল কলকাতায় ছিলাম। লক্ষ করেছি, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ধর্ম, সমাজ ও সাহিত্যের খোঁজ আমরা যতটা রাখি, ওপারের মানুষ আমাদের সম্পর্কে তেমনটা রাখতে পারেন না। এর অনেক কারণ আছে। কলকাতায় কোনো বই বা জার্নাল প্রকাশিত হলে কলেজ স্ট্রিটের দোকানে আসার আগেই বাংলাদেশের বুক স্টলে চলে আসে। খুব কমই বাংলাদেশের বইয়ের দেখা মেলে কলকাতার বইয়ের দোকানে। কলকাতার সব টিভি চ্যানেল আমাদের ড্রইং রুমে। আমাদের কোনো চ্যানেল দেখার সুযোগ নেই পশ্চিমবঙ্গে। আমার এক সংস্কৃতিকর্মী ছাত্র যথার্থই মন্তব্য করল, রোজা আর ঈদকে নিয়ে কলকাতার টিভি চ্যানেলে তেমন কোনো অনুষ্ঠান দেখা যায় না।
অথচ আমাদের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া দুর্গাপূজার বোধন থেকে বিসর্জন পর্যন্ত খবরে ও অনুষ্ঠানে মাতিয়ে রাখে। অর্থাৎ এ দেশের মানুষ দুই সম্প্রদায়ের অধিকার অভিন্ন ভাবতে অভ্যস্ত বলেই আমাদের মধ্যে এ স্বতঃস্ফূর্ততা রয়েছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কলকাতার চ্যানেলে মুসলমানের উৎসবের খবর-প্রতিবেদন জায়গা করে নিতে পারছে না। কলকাতার টিভিতে বাংলাদেশের চ্যানেল দেখতে না পাওয়ায় পুজো নিয়ে এ দেশে যে এত আয়োজন হচ্ছে তার খোঁজ ভারতবাসী পাচ্ছেন না। পেলে হয়তো কলকাতার চ্যানেলেও এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ত।
যোগাযোগহীনতা কতটা ক্ষতি করেছে তার একটি উদাহরণ দেব। আমি ১৯৯০-৯২ সালে গবেষণার প্রয়োজনে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বেশিরভাগ সময় পড়াশোনা করতাম। জার্নাল সেকশনের একজন ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান ছিলেন শঙ্করনাথ ভাদুড়ী। সংস্কৃতিমনা এ মানুষটি একটি গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মাঝে মাঝে আবেগে আপ্লুত হয়ে আমাকে বলতেন, তিনি শুনেছেন সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের আগে তাদের পৈতৃক বাড়ি ছিল বগুড়ার জলেশ্বরী তলায়। তিনি কখনো বাংলাদেশে আসেননি। তার খুব ইচ্ছা পৈতৃক ভিটে ছুঁয়ে দেখার। আমি বলি, এ আর এমন কী! একবার বাংলাদেশে এলেই ইচ্ছাপূরণ করা যায়। তিনি হেসে উড়িয়ে দিতেন। শেষবার আমি যখন কলকাতা ছাড়ব, আবার তিনি তার অতৃপ্ত বাসনার কথা বললেন। এবার আমি তাকে চেপে ধরলাম। বললাম, আপনার বাসনা পূরণের সব দায়িত্ব আমার।
আপনি বলুন কবে আসবেন। আপ্লুত হলেন ভাদুড়ী দা। সংকোচ ঝেড়ে ফেলে বললেন, ‘আমি যে যাব, আমার জীবনের নিরাপত্তা কী!’ অর্থাৎ তিনি বিশ্বাস করেন বাংলাদেশ একটি কঠিন মৌলবাদী দেশ। এখানে কোনো হিন্দু এলে কচুকাটা হবেন। আমি স্তম্ভিত হলাম। এমন ধারণার কারণ খুঁজলাম। দেখলাম এখানকার অনেক কাগজে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সংকট নিয়ে নানা মনগড়া রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। আমাদের কোনো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিপক্ষ দলকে ঘায়েল করার জন্য সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব নিয়ে একপেশে বিবৃতি দেন। কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক বিজ্ঞজন নিজেদের কায়েমি স্বার্থ হাসিলের জন্য পশ্চিমবঙ্গের সতীর্থদের কাছে পছন্দের হবে তেমন বক্তব্য প্রদান করেন। সেসব খুব গুরুত্ব পায় পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো কাগজে। বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হয়ে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া কোনো কোনো হিন্দু পরিবার আনুকূল্য পাওয়ার আশায় নির্যাতনের অনেক গল্প ফাঁদে।
আর সুবিধাবাদী কোনো কোনো গ্রুপ বাংলাদেশ সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণার সুযোগে সেসব প্রচার করে বিভেদ তৈরি করে দেয়। কিন্তু এ সত্যটি খাটো করে দেখলে চলবে না যে, হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রাখতে হলে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমাদের সহজ সম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়োজন আছে। তা সম্ভব দুই দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনাচরণ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখার মধ্য দিয়ে। না হলে সুযোগ সন্ধানী অন্ধকারের জীবরা উভয় দেশের মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সন্দেহের বিষ ছড়িয়ে দেবে। তাই এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে দুই পক্ষের দায়িত্বশীলদেরই।
আমার বরাবরই মনে হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় সম্প্রীতির পরিবেশ ধরে রাখতে পারলে এ দেশের ধর্ম-বণিক রাজনীতিকদের অপতৎপরতা আর জঙ্গিবাদ কখনো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে না। এজন্য অনালোকিত জনগোষ্ঠীকে আলোতে আনতে হবে আবহমান বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে। বিজ্ঞানমনস্কভাবে ধর্মচর্চা এবং বাঙালির হাজার বছরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পাঠক্রমে যুক্ত করতে হবে। আর এ ঐতিহ্যের সৌন্দর্য সাধারণ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে মিডিয়াকে। আলোর প্রক্ষেপণ ছাড়া কি অন্ধকার দূরীভূত হয়?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়