ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজত তাণ্ডব: গণশুনানিতে উঠে এলো পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের তাণ্ডব
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের তাণ্ডব। ফাইল ছবি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজত-জামায়াতের চালানো নজিরবিহীন তাণ্ডব নিয়ে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে ৩০ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের বেশিরভাগের বক্তব্যে সেই দিন পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টি উঠে এসেছে। এ ছাড়া গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তদের মুক্তি পাওয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।

রোববার (১৭ অক্টোবর) দুপুর ১২টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সার্কিট হাউসে ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন’ এই শুনানি গ্রহণ করে।

universel cardiac hospital

ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী সন্ত্রাস বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘুবিষয়ক ককাসের যৌথ উদ্যোগে এই গণকমিশন গঠন করা হয়।

গণকমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বে গণশুনানিতে অংশ নেন আদিবাসী ও সংখ্যালঘুবিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, সাবেক আইজিপি ও নিরাপত্তা বিশ্নেষক মোহাম্মদ নুরুল আনোয়ার, বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান, গণকমিশনের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, সমন্বয়কারী কাজী মুকুল, সদস্য মওলানা হাসান রফিক, সমাজকর্মী এসএম শহীদুল্লাহ, সমাজকর্মী সাইফ উদ্দিন, সাইফ রায়হান প্রমুখ।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীদের নারকীয় তাণ্ডবের বিষয়ে লিখিত ও মৌখিক সাক্ষ্য দিয়েছেন ৩০ জন।

সাক্ষ্যদাতাদের মধ্যে আছেন- আদিবাসী ও সংখ্যালঘুবিষয়ক সংসদীয় ককাসের সদস্য ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামি, জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট কাজী মাসুদ আহমেদ, জেলা জাসদের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার হোসেন সাঈদ, জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের জেলা সভাপতি ডা. আবু সাঈদ, সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক মনজুরুল আলম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক সাংবাদিক আবদুন নূর, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক মনির হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি দিলীপ নাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দীপক চৌধুরী বাপ্পী, অনুশীলন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদ শামীম, ২০১৬ সালের সাম্প্রদায়িক হামলার ভুক্তভোগী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের রসরাজ দাস, আশুগঞ্জ উপজেলা নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহিন সিকদার, আইনজীবী নাসির মিয়া, ভুক্তভোগী শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালীবাড়ি মন্দিরের সেবায়েত জীবন কুমার চক্রবর্তী।

এসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য র. আ. ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী প্রায় ৫০ মিনিট সময় দেওয়া সাক্ষ্যে তাণ্ডবের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।

১৭ অক্টোবর গণশুনানিতে সাক্ষ্য দিচ্ছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি।

তিনি বলেন, গত ২৬ মার্চ বিকেল থেকে হেফাজত তথা কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ছাত্ররা শহরে তাণ্ডব শুরু করে। ঐদিন বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙার খবরে আমি হেফাজত নেতা মোবারক উল্লাহ’র সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাকে জানান বাধা দিলেও কেউ কথা শুনছে না। ওই দিনই দল ভারি করে রেলওয়ে স্টেশনে হামলা করা হয়। তারা সরকারি স্থাপনাগুলো ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। কোনো রকম বাধা ছাড়াই তারা এ তাণ্ডব চালায়। ফায়ার সার্ভিসে খবর দিলে সেখান থেকে তারা জানায়, আমরা আগুন নেভাতে যেতে পারব না, ওপরের নির্দেশ আছে।

সংসদ সদস্য আরও জানান, এ হামলা ছিলো পূর্ব পরিকল্পিত। তাণ্ডব চালানো হবে বলে ২৫ তারিখই ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে বিষয়টি তিনি জানতেন না। ঘোষণার পর নাকি পুলিশ পাহারায় তাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে তিনি মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু তারা কেউ কোনো ধরণের ব্যবস্থা নেননি। যদি কারফিউ বা ১৪৪ ধারা জারি করা হতো তাহলে পরবর্তীতে এত বড় ধরণের ঘটনা ঘটতো না। ২৭ তারিখ হাইওয়ে থানা পুলিশ পোশাক বদল করে নিজেদেরকে রক্ষা করে। একজন এডিশনাল এসপি পালিয়ে গিয়ে জীবন বাঁচান।

সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তিনি অভিযোগ করেন, পুলিশ মাইকে ঘোষণা দিয়ে তাণ্ডবকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। আমার ইউনিভার্সিটির সামনে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল রক্ষায় যে মাওলানা কাজ করেছে তার নামে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

ফেসবুকে তাঁকে গালাগালি ও তাঁর নামে হেফাজতের মিথ্যাচারে প্রতিকার চেয়ে ডিজেটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, থানায় মামলা করলে সে মামলা সিআইডিতে পাঠানো হয়। সিআইডি জানায়, আইসিটি আইনে যে মামলা করেছি, তার কোনো প্রমাণ তারা পাননি।

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের এক প্রশ্নে জবাবে মোকতাদির চৌধুরী বলেন, আমি যখন তাদের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে গিয়েছি তখন আমার মামলা জজ সাহেব যাতে গ্রহণ না করেন সেজন্য দুইজন প্রভাবশালী মন্ত্রী জজ সাহেবকে ফোন করে বলেছেন। এইটার সাক্ষীও আছে।

তাণ্ডবের পর যে হেফাজত নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তারা অনেকেই জামিনে বের হয়ে গেছেন বলেও জানান তিনি।

সাজিদুর রহমান-মোবারক উল্লাহ
২৬ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজত কর্তৃক পরিচালিত তাণ্ডবের জন্য রাজপথে নেমে নির্দেশনা দিচ্ছেন মাওলানা সাজিদুর রহমান ও মোবারক উল্লাহ। ফাইল ছবি

ভুয়া ফেসবুক আইডি থেকে ষড়যন্ত্রমূলক পবিত্র ‘কাবাঘর’ অবমাননার অভিযোগে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর গ্রেপ্তার হওয়া নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জেলে পরিবারের সদস্য নিরক্ষর রসরাজ দাস দুই মাস ১৬ দিন জেল খেটে কারাগার থেকে বের হন। শুনানিতে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, পাঁচ বছর ধরে আদালতে হাজিরা দিতে দিতে আমি ক্লান্ত ও অসহায় হয়ে পড়েছি। হাজিরা দেওয়ার টাকা আমার নেই। রাষ্ট্রের কাছে এ মামলা থেকে আমি বেকসুর খালাস চাই।

আল-মামুন সরকার বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হেফাজত, বিএনপি, জামায়াত ও জেলার বাইরে থেকে আসা শিবিরকর্মীরা তাণ্ডব চালায়। আমার নিজের ও পরিবারের এবং নেতাকর্মীদের বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে তারা। আমরা পুলিশ প্রশাসনকে বারবার অবহিত করলেও তারা আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।

আইনজীবী নাসির মিয়া বলেন, জেলা পরিষদ মিলনায়তন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সিভিল সার্জন কার্যালয়সহ অনেক সরকারি কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে তাণ্ডবকারীরা। রেলস্টেশনের প্রতিটি কক্ষে আগুন জ্বলতে দেখেছি।

রেলস্টেশন
হেফাজতের আগুনে পুড়ে ছাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন। ফাইল ছবি

সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গণের সাধারণ সম্পাদক ও সাংবাদিক মনজুরুল আলম বলেন, এবারই প্রথম নয়, ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। গত মার্চ মাসে হেফাজতের ধ্বংসযজ্ঞে গান পাউডার ব্যবহার করা হয়। এখানে তিন দিন ধরে আগুন জ্বলেছে কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের কোনো কর্মী আগুন নেভাতে আসেননি। বারবার ফোন করেও কোনো সহযোগিতা পাইনি।

শ্রী মদন মোহন চক্রবর্তীর ছোট ছেলে জীবন কুমার চক্রবর্তী বলেন, আমাদের মন্দিরে তিন দফায় হামলা হয়। জিন্স প্যান্ট ও টি-শার্ট পরা যুবকরাও এতে অংশ নেয়। হামলকারীরা লুটপাট চালায়।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা দিলীপ নাগ বলেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ি এলাকায় হামলা হলে ইউএনও, ওসিকে ফোনে জানালে তারা নিরাপত্তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এমনকি তারা নিজেরাই বিপদগ্রস্ত আছেন বলে জানান।’ অ্যাডভোকেট কাজী মাসুদ অভিযোগ করেন, মাদরাসা ছাত্ররা এ তাণ্ডব চালিয়েছে। 

মাওলানা ক্বারী আনিসুর রহমান জানান, সবকিছুর নেতৃত্বে ছিলে হেফাজত। মসজিদের মাইকে হাইয়ালাল জিহাদ বলতে তিনি শুনেছেন।

কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, সাতক্ষীরাসহ সারাদেশে গত পাঁচ বছরে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক হামলার বিষয়ে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য তুলে ধরে গণকমিশনের প্রতিবেদন ও সুপারিশসহ শ্বেতপত্রে অন্তর্ভুক্ত করে আগামী ৩০ নভেম্বর প্রকাশ করা হবে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

শেয়ার করুন