শুভ জন্মদিন শেখ রাসেল ।। সেলিনা হোসেন

সেলিনা হোসেন

শেখ রাসেল
শেখ রাসেল। ফাইল ছবি

আজকে শেখ রাসেল সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তার কিছু ছবির কথা আমার খুব মনে পড়ছে। একটি ছবি—মুক্তিযুদ্ধের সময় পতাকা হাতে রাসেল। সেই পতাকায় লাল গোলাকার বৃত্তের মধ্যে বাংলাদেশের মানচিত্র ছিল। অন্য ছবিটি স্বাধীনতার পর তোলা। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গমাতাসহ পরিবারের অন্যরা ধানমণ্ডি ১৮ নম্বর রাস্তার একটি বাড়িতে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের বন্দি করে রেখেছিল, সেই বাড়ি থেকে মুক্ত হওয়ার আগে রাসেলের একটি ছবি তোলা হয়েছিল, যেখানে ওর সঙ্গে আরেকটি শিশু ছিল। ওদের মাথায় ছিল হেলমেট, ওরা মাটিতে শুয়ে যুদ্ধের সৈনিকের ভঙ্গিতে ছিল। ওদের সামনে ছিল একটি স্টেনগান। ওদের পেছনে আছে চারজন ভারতীয় সৈনিক। প্রথম ছবিতে আমাদের সামনে মুক্তিযুদ্ধের সূচনার ছবি। শেষ ছবিটি স্বাধীনতার পরের দিনের ছবি। প্রথম ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিতীয় ছবিতে সে যুদ্ধের বঙ্গ সৈনিক। ১৯৭১ সালে ও ছয় বছরের শিশু। এই দুটি ছবি দেখে আমার একটি কথাই মনে হয়েছে যে ওই ছয় বছরের শিশুর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিস্ময়করভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আমি এই ছবি দুটিকে কোনো সাধারণ ছবি মনে করছি না।

আজ শেখ রাসেলের জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের এই দিনে তার জন্ম হয়েছিল। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লেখা থেকে জানতে পারি, ৩২ নম্বর রোডের যে ঘরটিতে তার জন্ম হয়েছিল সে ঘরটি ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোবারঘর। এই বাড়িতে ছোট্ট শিশু রাসেল দিনে দিনে বড় হয়ে ১০ বছর বয়সে পৌঁছে গেছে। ৩২ নম্বর বাড়িটি এভাবে রাসেলের স্মৃতির বাড়ি।

‘শেখ রাসেল’ নামে একটি বই লিখেছেন শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনা। দুজনেই বইটিতে তাঁদের ছোট ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে স্মৃতিচারণা করেছেন সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, “১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর রাসেলের জন্ম হয় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় আমার শোয়ার ঘরে। দোতলা তখনও শেষ হয়নি। বলতে গেলে মা একখানা করে ঘর তৈরি করেছেন। একটু একটু করেই বাড়ির কাজ চলছে। নিচতলায় আমরা থাকি। উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরটা আমার ও কামালের। সেই ঘরেই রাসেল জন্ম নিল রাত দেড়টায়। আব্বা নির্বাচনী মিটিং করতে চট্টগ্রাম গেছেন। ফাতেমা জিন্নাহ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। সর্বদলীয় ঐক্য পরিষদ আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে একটা মোর্চা করে নির্বাচনে নেমেছে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দল। তখনকার দিনে মোবাইল ফোন ছিল না। ল্যান্ডফোনই ভরসা। রাতেই যাতে আব্বার কাছে খবর যায় সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকাকাকা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার এবং নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আর জেগে ওঠে। আমরাও ঘুমে ঢুলঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমনবার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল। মাথার চুল একটু ভেজা মনে হলো। আমি আমার ওড়না দিয়েই মুছতে শুরু করলাম। তারপরই এক চিরুনি নিলাম মাথার চুল আঁচড়াতে। মেজ ফুফু নিষেধ করলেন, মাথার চামড়া খুব নরম তাই এখনই চিরুনি চালানো যাবে না। হাতের আঙ্গুল বুলিয়ে সিঁথি করে দিতে চেষ্টা করলাম।

আমাদের পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট রাসেল। অনেক বছর পর একটা ছোট বাচ্চা আমাদের ঘর আলো করে এসেছে, আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। আব্বা বার্ট্র্যান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন, রাসেলের বই পড়ে মাকে ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। মা রাসেলের ফিলোসফি শুনে শুনে এত ভক্ত হয়ে যান যে নিজের ছোট সন্তানের নাম রাসেল রাখলেন। ছোট্ট রাসেল আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। মা রাসেলকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সংসারের কাজ করতেন, স্কুল বন্ধ থাকলে তার পাশে শুয়ে আমি বই পড়তাম। আমার চুলের বেণি ধরে খেলতে খুব পছন্দ করতো ও। আমার লম্বা চুলের বেণিটা ওর হাতে ধরিয়ে দিতাম। ও হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হাসতো। কারণ নাড়াচাড়ায় মুখে চুল লাগতো তাতে খুব মজা পেত।

জন্মের প্রথম দিন থেকেই ওর ছবি তুলতাম, ক্যামেরা আমাদের হাতে থাকতো। কত যে ছবি তুলেছি। ওর জন্য আলাদা একটা অ্যালবাম করেছিলাম যাতে ওর জন্মের দিন, প্রথম মাস, প্রতি তিন মাস, ছয় মাস অন্তর ছবি অ্যালবামে সাজানো হতো। দুঃখের বিষয় ওই ফটো অ্যালবামটা অন্যসব জিনিসপত্রের সঙ্গে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লুট করে নেয়। হারিয়ে যায় আমাদের অতি যত্নে তোলা আদরের ছোট্ট ভাইটির অনেক দুর্লভ ছবি।

বাসার সামনে ছোট্ট একটা লন। সবুজ ঘাসে ভরা। আমার মা খুবই যত্ন নিতেন বাগানের। বিকেলে আমরা সবাই বাগানে বসতাম। সেখানে একটা পাটি পেতে ছোট্ট রাসেলকে খেলতে দেওয়া হতো। এক পাশে একটা ছোট্ট বাঁশ বেঁধে দেওয়া ছিল, সেখানে রাসেল ধরে ধরে হাঁটতে চেষ্টা করতো। তখন কেবল হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে। আমরা হাত ধরে হাঁটাতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু কিছুতেই হাঁটতে চাইতো না। ওর স্বাস্থ্য খুব ভালো ছিল। বেশ নাদুস-নুদুস একটা শিশু। আমরা ভাইবোন সব সময় ওকে হাত ধরে হাঁটাতাম। একদিন আমার হাত ধরে হাঁটছে। ওর যেন হাঁটার ইচ্ছা খুব বেড়ে গেছে। সারা বাড়ি হাত ধরে ধরে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে পেছনের বারান্দা থেকে সামনের বারান্দা হয়ে বেশ কয়েকবার ঘুরলো। এই হাঁটার মধ্যে আমি মাঝে মাঝে চেষ্টা করছি আঙ্গুল ছেড়ে দিতে, যাতে নিজে হাঁটতে পারে। কিন্তু সে বিরক্ত হচ্ছে, আর বসে পড়ছে, হাঁটবে না আঙ্গুল ছাড়া। তার সাথে হাঁটতে হাঁটতে আমি বরাবরই চেষ্টা করছি যদি নিজে হাঁটে। হঠাৎ সামনের বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে আমার হাত ছেড়ে নিজে হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে চলছে। আমি পেছনে পেছনে যাচ্ছি। সেই প্রথম হাঁটা শুরু করলো। আমি ভাবলাম কতটুকু হেঁটে আবার আমার হাত ধরবে। কিন্তু যতই হাঁটছি দেখি আমার হাত আর ধরে না, চলছে তো চলছেই, একেবারে মাঝের প্যাসেজ হয়ে পেছনের বারান্দায় চলে গেছে। আমি তো খুশিতে সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করেছি যে, রাসেল সোনা হাঁটতে শিখে গেছে।…

চলাফেরায় বেশ সাবধানি কিন্তু সাহসী ছিল, সহসা কোনও কিছুতে ভয় পেত না। কালো কালো বড় পিঁপড়া দেখলে ধরতে যেত। একদিন একটা বড় ওলা (বড় কালো পিঁপড়া) ধরে ফেললো আর সাথে সাথে কামড় খেল। ছোট্ট আঙ্গুল কেটে রক্ত বের হলো। সাথে সাথে ওষুধ দেওয়া হলো। আঙ্গুলটা ফুলে গেছে। তারপর থেকে আর পিঁপড়া ধরতে যেত না। কিন্তু ওই পিঁপড়ার একটা নাম নিজেই দিয়ে দিল। কামড় খাওয়ার পর থেকেই কালো বড় পিঁপড়া দেখলেই বলতো ‘ভুট্টো’। নিজে থেকেই নামটা দিয়েছিল।”

ভাবতে অবাক লাগে ছয় বছরের শিশু ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক টানাপড়েন, অসহযোগ আন্দোলন, ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো ইত্যাদি শব্দ থেকে কালো পিঁপড়ার সঙ্গে ভুট্টোকে যুক্ত করেছে। যে ভুট্টো ১৯৭০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারছিল না এবং প্রবল বিরোধিতা করে একটি ২৫ মার্চের রাতের গণহত্যার একজন হিসেবে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর যখন পেছন ফিরে আমরা দেখি, সে সময় ৩২ নম্বর বাড়ির শিশুটি কিভাবে অনবরত শুনতে থাকা ভুট্টো নামটি তার কাছে কালো পিঁপড়ার সমান্তরাল হয়। শিশু বয়সে এই বোধের জায়গা তৈরি হয়ে যাওয়া একজন অসাধারণ শিশুর পক্ষেই সম্ভব। ওই শিশুটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে কতিপয় দুর্বৃত্ত সেনা সদস্য, যাদের কাছে মানবিক বোধের জায়গাটি শূন্য হয়ে গিয়েছিল।

শিশুটি যখন ঘাতকদের বর্বর নৃশংসতার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আমি মায়ের কাছে যাব, সেই অনুরোধও সেই সব নির্মম মানুষের কাছে কোনো মানবিক মূল্য পায়নি। এভাবে শিশুহত্যা আমাদের জাতীয় জীবনকে গ্লানিময় করে রেখেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর স্মৃতিচারণার এক জায়গায় লিখেছেন, ‘রাসেল এমনিতে খাবার খেতে চাইত না, কিন্তু রান্নাঘরে বাবুর্চি, দারোয়ান, কাজের বুয়ারা ফুল আঁকা টিনের থালায় করে যখন সবাই খেত তখন ওদের সঙ্গে বসত। রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে বসে লাল ফুল আঁকা থালায় করে কাজের লোকদের সাথে ভাত খেতে পছন্দ করত।’

এই কথাটুকুর মধ্যে আমরা একটি শিশুর সাধারণ মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা, চলাফেরা, ভাত খাওয়ার জায়গা দেখতে পাই। বোঝা যায়, শিশুটির মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার ইচ্ছা কত প্রবল ছিল। এটাই একজন শিশুকে চিনে ওঠার সুযোগ করে দেয়। আমরা এমন শিশুটি হারিয়েছি, যে তার মানবিক বোধ নিয়ে একজন পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠত। রাজনীতি, সমাজনীতির মতো জায়গায় এমন অসাধারণ বোধের মানুষই তো বিশ্বের প্রতিটি দেশের গণমানুষের প্রবল আকাঙ্ক্ষার ব্যক্তি। আমরা আমাদের জীবন থেকে এমন বোধের মানুষ হারিয়েছি।

প্রধানমন্ত্রীর একটি বই আছে ‘পিপল অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ নামে, সেই বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন শেখ রাসেলকে। উৎসর্গে লেখা আছে, ‘In front memory of my youngest brother Sheikh Rusel, he was a rarity of a flower plucked in the cruelty of evil. A child whose future was sensed out in a present narrated by the sinister darkness of conspiracy’

আমাদের সামনে আজ রাসেল নেই, এটি একটি নির্মম সত্য। আমাদের অজস্র শিশু স্মরণ করবে রাসেলকে ইতিহাসের সঙ্গে তার নামটি দেখে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

শেয়ার করুন