বাংলাদেশ থেকে ধর্মান্ধ, জঙ্গি ও মৌলবাদী গোষ্ঠীকে সমূলে বিনাশ করা হবে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ তাদের ধর্ম পালন করবে। আমরা ধর্ম পরায়ণ হতে চাই, ধর্মান্ধ হতে চাই না।
আজ বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গৌরব ‘৭১ আয়োজিত সাম্প্রদায়িক হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার প্রতিবাদে প্রতিরোধ সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
হানিফ বলেন, এই বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতি আছে। আমরা যাত্রা, পালাগান, জারি-সারি, পল্লীগীতি, লোক সংস্কৃতির চর্চা করে এসেছি। গ্রামে লোক সংস্কৃতি ছিলো, মানুষের মধ্যে সামাজিক বন্ধন গড়ে উঠেছিলো। দুর্ভাগ্য আমাদের, আজ সমাজ থেকে শত বছরের লোক সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে। আজকে গ্রাম থেকে নাটক, পালা গান, জারি সারি ও পুঁথি গান হারিয়ে গেছে। আজকে সমাজ থেকে সংস্কৃতি চলে গেছে। ওয়াজ মাহফিলের মধ্য মানুষকে ধর্মান্ধ করার কাজ শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের মাথায় অন্য ধর্ম পালনকারীদের ওপর হামলা করা হয় কেন? এটা জানতে আমাদেরকে গোঁড়ায় যেতে হবে। বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, আওয়ামী লীগ দেশে রাজনৈতিক বিভেদ সৃষ্টি করেছে, সম্প্রীতি বিনষ্ট করছে। তারা নির্লজ্জ মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা করে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিলো। এই জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলো। কুখ্যাত রাজাকার গোলাম আজমকে বাংলাদেশে এনে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার গাছ রোপণ করে দিয়েছিলেন। এরপর এরশাদ, খালেদা জিয়া সেই গাছকে বড় করেছেন।
আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য একাত্তরে আমরা জাতির পিতার নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিলাম। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমানের রক্তের স্রোতে গড়া এই বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ স্বাধীন করতে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ রক্ত দিয়েছে। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছিলো। এই বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ ছিলো। জাতির পিতা আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছিলেন। আজকের সেই বাংলাদেশ আমাদের মাঝ থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
হানিফ আরও বলেন, বাংলাদেশে সকল ধর্মের মানুষ ধর্ম পালন করবে। আমরা ধর্ম পরায়ণ হতে চাই, ধর্মান্ধ হতে চাই না। আজকে মানুষকে ধর্মান্ধ করার মধ্য দিয়ে সমাজকে কলুষিত করা হচ্ছে। একাত্তরে ধর্মের ভূল ব্যাখ্যা করে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, মা-বোনদের নির্যাতন করা হয়েছে। এখনো আবার ধর্মের অপব্যাখ্যা করে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর আঘাত করা হচ্ছে। এটা বরদাশত করার মতো নয়। আমরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে লড়াই করেছি। শেখ হাসিনার একজন কর্মী থাকতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা যাবে না।তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আহ্বান জানাই, ২০১২ সালের রামু, পাবনার সুজানগর, নাসিরনগর, সুনামগঞ্জের শাল্লায় সাম্প্রদায়িক হামলা, লুটপাট ঘটেছিলো সেগুলোর বিচার এখনো সম্পন্ন হয়নি। অতিদ্রুত বিচার করার দাবি জানাই। বিচার বিলম্বের কারণে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বারবার হামলা করার সাহস পাচ্ছে। যদি সাধারণ আইনে বিচার না হয় তাহলে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে বিচার করতে হবে। শেখ হাসিনা বলেছেন, এবারের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদেরকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। আমরা সকল ধর্মের মানুষের শঙ্কা, ভীতি দূর করতে চাই। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে চাই।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য (প্রশাসন) ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে দেখা যায় ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে বঙ্গবন্ধু দুই সম্প্রদায়কে রক্ষা করেছেন। এরপর বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দূর করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় কাজ করেছেন। এমনকি সে সময়ে ইত্তেফাক পত্রিকায় শিরোনামও হয়েছে “শেখ মুজিবের ওপরও হামলা”। এসবের পরও বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে কাজ করেছেন। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও নিজ হাতে রান্না করে সব ধর্মের মানুষকে খাওয়াতেন।
তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক এসব ঘটনা দাঙ্গা নয়, এটা দুর্বলদের ওপর আক্রমণ। এ আক্রমণের লক্ষ্য বঙ্গবন্ধু, এ আক্রমণের লক্ষ্য শেখ হাসিনা। আমাদের শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে হবে।আমাদের যাদের সাথে আওয়ামী লীগের, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের রক্তের সম্পর্ক তাদের সোচ্চার হতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে অধ্যাপক সামাদ বলেন, এসব হামলা থেকে উত্তরণের জন্য আদর্শ ও নিষ্ঠাবান কর্মী তৈরি করতে হবে। তার জন্য ১৯৭২ এর সংবিধানে ফিরে যেতে হবে। তাহলে কেবল বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ সম্ভব।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফি বলেন, সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, লা ইকরা ফিদ দিন। অর্থাৎ আমি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করি না। তাহলে আমি, আপনি কি বলি সেটা তো কোন ব্যাপার না। সৃষ্টিকর্তার কথাই আসল কথা। তাহলে আমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে এসব করছি কেন?
তিনি বলেন, কেয়ামত পর্যন্ত একাত্তর পরাজিত হবে না। সব অপশক্তি অতীতের ন্যায় পরাজিত হবে। স্বাধীনতা বিরোধীদের পরাজিত না করে আমরা ঘরে যাবো না।
নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস এমপি বলেন, বাংলাদেশের শেষ ঠিকানা বঙ্গবন্ধু, আর বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে জননেত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা সোনার বাংলাদেশ গড়ার জন্য যুদ্ধ করেছি। সকল ধর্মের মানুষের রক্তে গড়া এই বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা সহ্য করা হবে না।
সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম বলেন, স্বাধীনতা বিরোধীরা এখনো বঙ্গবন্ধুর দেশে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। তারা ভুলে গেছে এদেশ বঙ্গবন্ধুর দেশ, এদেশ মুক্তিযুদ্ধের দেশ, এদেশ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। এদেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের ঠাঁই আগেও ছিল না, এখনো হবে না। তাদেরকে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানে প্রতিহত করার আহ্বান জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস বলেন, আমরা ভালো নাই, বাংলাদেশের মানুষ ভালো নেই। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ, দুই লাখ মা-বোন নির্যাতিত হয়েছে দেশের এরকম অবস্থা দেখার জন্য নয়। কুমিল্লার পর রংপুরেও ঘটনা ঘটানো হলো। এ আঘাতটা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর নয়, এ আঘাতটা ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর।
হুঁশিয়ারি দিয়ে এ ছাত্রনেতা বলেন, রাতের আঁধারে হামলা নয়। কাপুরুষের দল বুকে সাহস থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসো। আমরা ছাত্রলীগ তোদের দেখে নেবো।
সাবেক ছাত্রনেতা আমিনুল ইসলাম আমিন বলেন, কথায় কথায় মুরতাদ, নাস্তিক ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ শকুনের হাতে পড়েছে। এদেরকে রুখতে হবে।
কুষ্টিয়া-৩ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জ বলেন, জঙ্গিবাদ রুখে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে জনগণকে রাজপথে নামতে হবে।
গৌরব ‘৭১ এর সভাপতি এসএম মনিরুল ইসলাম মনির সভাপতিত্বে এবং সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক এফ এম শাহীনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আওয়ামী যুব মহিলা লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট কুহেলী কুদ্দুস মুক্তি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নুরুল আমিন রুহুল এমপি, মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ, সাংস্কৃতিক সম্পাদক আবদুল মতিন, মামুন আল মাহাতাব স্বপ্নিল, ড. শাহাদাত হোসেন নিপু, তানভীন সুইটি, বাণী ইয়াসমিন হাসি, বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবিসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
এই প্রতিরোধ সমাবেশের পর সাম্প্রদায়িক হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার প্রতিবাদে লাঠি মিছিলও করেছে গৌরব ’৭১। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে এ মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ। সমাবেশে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরিয়ে দিতে সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।