বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ

আবদুল লতিফ মণ্ডল

পথশিশুর খাদ্যগ্রহণ / ক্ষুধা সূচক
ফাইল ছবি

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই)-২০২১’, যা আমাদের কাছে ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’ নামেও পরিচিত। আইরিশ সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড এবং জার্মান সংস্থা ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে যৌথভাবে জিএইচআই-২০২১ প্রকাশ করেছে। ১১৬টি দেশের তথ্য এতে স্থান পেয়েছে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘The aim of the GHI is to trigger action to reduce hunger around the world’, অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা হ্রাসে কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি জিএইচআই’র লক্ষ্য। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা পরিস্থিতি নিয়ে জিএইচআই ২০২১-এ যেসব তথ্য ও ফাইন্ডিংস এসেছে, তা পর্যালোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচক নির্ধারণে চারটি মাপকাঠি ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো হলো- এক. অপুষ্টির হার, দুই. পাঁচ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে উচ্চতার তুলনায় কম ওজনের শিশুর হার, তিন. পাঁচ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে কম উচ্চতার শিশুর হার, এবং চার. পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যুর হার।

জিএইচআই-এ ১০০ পয়েন্টের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের স্কোর নির্ধারণ করা হয়েছে। সূচকে সবচেয়ে ভালো স্কোর হলো শূন্য। স্কোর বাড়ার অর্থ হলো, সেই দেশের ক্ষুধা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর স্কোর কমে যাওয়ার অর্থ হলো, সেই দেশের খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। এবারের সূচকে পাঁচেরও কম স্কোর নিয়ে ক্ষুধা সূচকের সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ১৮টি দেশ।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে-বেলারুশ, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, ব্রাজিল, চিলি, চীন, ক্রোয়েশিয়া, কিউবা, এস্তোনিয়া, কুয়েত, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া ইত্যাদি দেশ। ক্ষুধা সূচকে দুর্বলতম অবস্থানে আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া (১১৬)।

জিএইচআই-২০২১ যেসব গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ক. ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই বিপজ্জনভাবে পথভ্রষ্ট হয়েছে। জিএইচআই’র চলতি প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, সারা বিশ্ব, বিশেষ করে ৪৭টি দেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা হ্রাস করে তা নিুস্তরে (ষড়ি ষবাবষ) আনতে ব্যর্থ হবে।

দুই. বিভিন্ন দিক থেকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন খাদ্যনিরাপত্তা। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া এবং করোনার প্রভাবজনিত অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জগুলো ক্ষুধা বৃদ্ধির গতিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। তিন. কয়েক দশক নিুমুখী থাকার পর পুষ্টিহীনতায় ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চার. সাহারার দক্ষিণের আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় চরম ক্ষুধা বিরাজমান।

পাঁচ. আরও অনেক দেশে ক্ষুধার্তের হার উদ্বেগজনক। ছয়. দেশে দেশে, অঞ্চলে অঞ্চলে, জেলায় জেলায় এবং সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিরাজমান বৈষম্য ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’-এসডিজির এ লক্ষ্য অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জিএইচআই-২০২১ রিপোর্টে বলা হয়েছে, এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হলো সশস্ত্র সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও আর্থিক ক্ষতি স্পষ্টত প্রতীয়মান হচ্ছে, কিন্তু বিশ্ব তা উপশমে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

২০১৯ সালে প্রকাশিত জিএইআই-এ বলা হয়, বিশ্বজুড়েই বাড়ছে ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ শিশু তহবিল এবং আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (ইফাদ) যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘দ্য স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্বে প্রতি নয়জনের একজন ক্ষুধায় ভোগে।

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা ২০১৭ সালে ছিল ৮১ কোটি ১০ লাখ। সে সংখ্যাটি বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০ সালে ৮২ কোটি ১০ লাখে দাঁড়ায়। শতকরা হিসাবে আফ্রিকার জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগলেও অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা এশিয়ায় বেশি। এশিয়ায় প্রায় ৫১ কোটি ৩৯ লাখ মানুষ পুষ্টিহীনতার শিকার।

জিএইচআই ২০২০ অনুযায়ী, অপুষ্টিজনিত কারণে ১৪ কোটি ৪০ লাখ শিশুর উচ্চতা অনুযায়ী দেহের ওজন কম। এ ছাড়া ২০১৮ সালে ৫৩ লাখ শিশু পাঁচ বছর বয়স হওয়ার আগেই মারা গেছে। তবে বিশ্বের সব জায়গায় তা সমান নয়। বিশেষ বিশেষ দেশ, অঞ্চল বা সম্প্রদায়ে ক্ষুধার মাত্রা মারাত্মক পর্যায়ে আছে।

একাধিক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, গত দেড় বছর ধরে করোনা মহামারির প্রভাবে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্তের হারে উল্লম্ফন ঘটেছে। জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও), ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট (আইএফএডি), ইউনাইটেড নেশনস চিল্ড্রেন ইমার্জেন্সি ফান্ড (ইউনিসেফ), ইউএন ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) এবং ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএইচও) যৌথ উদ্যোগে করা এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১১ কোটি ৮০ লাখ; শতকরা হিসাবে এ বৃদ্ধির হার প্রায় ১৮ শতাংশ। উপর্যুক্ত প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে বিশ্বকে কীভাবে মুক্ত করা যায়, বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এখন সেই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

এবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২১-এ ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬তম। ২০২০, ২০১৯ ও ২০১৮ সালের সূচকে অবস্থান ছিল যথাক্রমে ৭৫তম, ৮৮তম ও ৮৬তম। এতে দেখা যায়, ২০২০ সালে সূচকে উন্নতি ছিল ১৩ ধাপ, যা এবার ধরে রাখা যায়নি। তবে সূচকে গতবারের চেয়ে একধাপ পিছিয়ে গেলেও বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১০১তম ও ৯২তম।

তাছাড়া সূচকে বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ১, যখন ভারত ও পাকিস্তানের স্কোর যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৫ এবং ২৪ দশমিক ৭। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সূচকে সবচেয়ে ভালো স্কোর হলো শূন্য। স্কোর বাড়ার অর্থ হলো, ক্ষুধা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর স্কোর কমে যাওয়ার অর্থ হলো, খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

এটা ঠিক, ২০২০ সালে বাংলাদেশের স্কোর ‘গুরুতর’ পর্যায় ২০ দশমিক ৪ পয়েন্টে থাকলেও ২০২১ সালে এ স্কোর ১৯ দশমিক ১ পয়েন্টে নেমে এসেছে, যা সহনীয় পর্যায় বলে ধরা হয়। তবে এতে আমাদের আত্মতৃপ্তির কোনো অবকাশ নেই। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে আফ্রিকার ঘানা, ইকুয়েডর, সেনেগাল, গাম্বিয়া, ক্যামেরুন ইত্যাদি দেশ এবং প্রতিবেশী মিয়ানমার ও শ্রীলংকা আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। স্কোরেও তারা আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো এ অবস্থা ধরে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়া।

এতে প্রধান অন্তরায় করোনার অভিঘাত। সরকারিভাবে কোনো তথ্য প্রকাশ করা না হলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে একাধিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান/সংস্থার গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে দেশে দারিদ্র্যহারে উল্লম্ফন ঘটেছে। এ হার দাঁড়িয়েছে ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশে। ওয়াশিংটনভিত্তিক জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালপ পরিচালিত ‘স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ওয়ার্কপ্লেস ২০২১’ শীর্ষক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, করোনার সময় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে।

করোনার কারণে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমেছে। প্রধান খাদ্যশস্য চাল চাহিদার তুলনায় উৎপাদিত না হওয়ায় সরকার চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ১০ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রয়োজনে আরও চাল আমদানি করা হবে। বিশ্ববাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় জনগণকে বর্তমানের ৪৭-৪৮ টাকা কেজির মোটা চাল আরও বেশি দামে কিনতে হবে। চালের উচ্চমূল্যের কারণে জনগণকে আমিষজাতীয় খাবার কেনা অনেকটা কমিয়ে দিতে হয়। এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও মহিলাদের পুষ্টির অভাব ঘটে। এতে অবনতি ঘটে তাদের স্বাস্থ্যের।

২০১৪ সালে প্রকাশিত দারিদ্র্য মানচিত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট ৬৪টি জেলার ৩৯টিতে পাঁচ বছর বয়সের নিচে খর্বাকৃতি শিশুর এবং ৫৫টি জেলায় পাঁচ বছর বয়সের নিচে কম ওজনের শিশুর হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি। জিএইচআই-২০২১ রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে খর্বাকৃতি শিশুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ২০০০ সালের পাঁচ বছর বয়সের নিচে খর্বাকৃতি শিশুর হার ৫১ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে পাঁচ বছর বয়সের নিচে কম ওজনের শিশুর হার ২০০০ সালের ১২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৯ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পাঁচ বছর বয়সের কম শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা কমেছে। ২০০০ সালে যা ছিল ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ, তা এখন ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। সার্বিকভাবে পুষ্টি স্বল্পতার জন্য চিহ্নিত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- আর্থিক সামর্থ্যরে অভাবে পুষ্টিমানসম্পন্ন প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহে অপারগতা, মা ও শিশুর পর্যাপ্ত যত্নের অভাব এবং দুর্বল পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা, শিশুকে মায়ের দুধ না খাওয়ানো, অসচেতনতা ও অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবা। গত কয়েক বছরে এসব বিষয়ে কিছুটা উন্নতি হলেও তা আন্তর্জাতিক মান থেকে অনেক দূরে।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২০-এর তুলনায় বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২১-এ বাংলাদেশ এক ধাপ পিছিয়ে পড়লেও ১০০ পয়েন্টের স্কোরে উন্নতি করেছে। এতে ক্ষুধার মাপকাঠিতে বাংলাদেশ ‘সিরিয়াস’ বা গুরুতর পর্যায় থেকে উন্নীত হয়ে ‘মডারেট’ বা সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। এটি ভালো খবর। তবে আমাদের আত্মতৃপ্তিতে ভোগা উচিত হবে না। আফ্রিকার কিছু দেশসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলো আমাদের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। তাদের কাতারে শামিল হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

শেয়ার করুন