এবারের জলবায়ু সম্মেলনে অভিযোজন ও প্রশমনে সমান অর্থ চাইবে বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

কপ-২৬
ছবি : ইন্টারনেট

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় অভিযোজন ও প্রশমনে সমান অর্থ চায় বাংলাদেশ। এবারের জলবায়ু সম্মেলনে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ রাখা, জলবায়ু অভিযোজন কার্যক্রম বৃদ্ধি, লস অ্যান্ড ড্যামেজের জন্য একটি সেক্রেটারিয়েট স্থাপনসহ একাধিক দাবি থাকবে বাংলাদেশের।

প্যারিস চুক্তির আর্টিকল-৬ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার অঙ্গীকার করেছিল ধনী দেশগুলো। সেই প্রতিশ্রুত অর্থ পাচ্ছে না স্বল্পোন্নত দেশগুলো। সবুজ প্রযুক্তি হস্তান্তরে এগিয়ে আসার জন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানাবে বাংলাদেশ।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বলছে, এখন অভিযোজনে অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণ কমানোতে অধিক অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, প্রশমনে ব্যয় করা হচ্ছে খুবই কম অর্থ। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্বল্পোন্নত দেশগুলো এরই মধ্যে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো বড় বড় দুর্যোগ বেড়েছে। এতে উপকূলীয় এলাকার অনেক মানুষ আবাসস্থল ও কাজ হারাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চল থেকে শহরগুলোয় অভিগমনের মাত্রা বেড়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম দাবি থাকবে অভিযোজন ও প্রশমনে ৫০:৫০ ভাগ অর্থ প্রদান করা।

আগামী রবিবার (৩১ অক্টোবর) থেকে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে শুরু হচ্ছে জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬)। প্রতিবছর একবার এই সম্মেলন হলেও ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির পর এবারই বড় কলেবরে বসছে জলবায়ু সম্মেলন। আগামী ১২ নভেম্বর এই সম্মেলন শেষ হবে। কভিড-১৯ মহামারির কারণে গত বছর ভার্চুয়ালি এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবারের আয়োজনে ১২০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বা তাঁদের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। ইউনাইটেড নেশনসের এ বছরের ১১ ফেব্রুয়ারির তথ্য মতে, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) সংখ্যা ৪৬। এসব দেশের মধ্যে বড় ভূমিকা রাখার কথা বাংলাদেশের। এ ছাড়া জলবায়ু ঝুঁকি ফোরামের (সিভিএফ) প্রধান হিসেবেও সম্মেলনে ভূমিকা রাখবে বাংলাদেশ। জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এদিকে এ সম্মেলন শুরুর মাত্র দিন কয়েক আগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের কারণে যে হারে দূষণ বাড়ছে তাতে চলতি শতাব্দীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। অথচ প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে ঠিক হয়েছিল, তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির মধ্যে আটকে রাখতে হবে।

জলবায়ু সম্মেলনে প্রতিটি দেশ তাদের প্রস্তাব জমা দেয়। বাংলাদেশও তা প্রস্তুত করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্যারিস চুক্তির শর্ত হিসেবে এই শতাব্দীতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখতে হবে। কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর প্রতিশ্রুত বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে বাংলাদেশ এই বিনিয়োগ আরো বাড়ানোর কথা বলবে। এই খাত থেকে অভিযোজন ও প্রশমনে সমান অর্থ ব্যয় করতে হবে।

যেসব দেশ বেশি দূষণ করছে তাদের কার্যকর এনডিসি দিতে হবে, যা গ্লাসগোতেই নিশ্চিত করতে চাইবে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের বক্তব্য থাকবে, অনেক দেশের তুলনায় আমাদের দূষণ সামান্য। এটাও বাংলাদেশ কমাতে চায়। সে জন্য উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতা লাগবে। বাংলাদেশ তাদের কাছে প্রযুক্তি চায়। কয়লাভিত্তিক জ্বালানি বন্ধ করতে হলে বাংলাদেশকে অন্য প্রযুক্তিতে যেতে হবে। সেগুলো খুবই ব্যয়বহুল এবং বাংলাদেশের কাছে নেই। এ কারণে অনুরোধ থাকবে, উন্নত দেশগুলো যেন বাংলাদেশকে গ্রিন প্রযুক্তি সরবরাহ করে; সেটা যেন বাংলাদেশ খুব কম অর্থে পেতে পারে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীর ভাঙন, বন্যা ও খরার কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের পুনর্বাসনের দায়িত্ব উন্নত দেশগুলোকে নিতে হবে। এগুলো বাংলাদেশ ও সিভিএফেরও দাবি থাকবে বলে জানিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার ভৌমিক বলেন, ‘প্যারিস চুক্তির পর এবারের জলবায়ু সম্মেলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাইব, সম্মেলনস্থল থেকেই আরো বেশি অঙ্গীকার আসুক। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য প্রতিশ্রুত আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অভিযোজন ও প্রশমনে সমান অর্থ ব্যয় করার দাবি তুলব আমরা। এ ছাড়া এখন ১০ বছর পর ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি) আপডেট করা হয়। আমরা পাঁচ বছর পর পর সেটার আপডেট চাইব।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে গ্লোবাল ক্লাইমেট ফান্ডের অ্যাকসেস আছে শুধু পিকেএসএফ ও ইডকলের। এই অ্যাকসেস আরো বাড়াতে বলব, যাতে আমরা আরো বেশি কাজ করতে পারি। এলজিইডি, বন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, সেডা, বিসিসিটিসহ যাদের সক্ষমতা আছে তাদের যাতে অ্যাকসেস দেওয়া হয়, সে ব্যাপারেও আমরা কাজ করব।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক অধ্যাপক খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ জন্যই এবারের জলবায়ু সম্মেলন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নাজুকতা নিরসন, দুর্যোগঝুঁকি হ্রাস, অভিযোজন ও প্রশমনের ক্ষেত্রে জোর দেওয়া উচিত। গ্রিন ও ক্লিন এনভায়রনমেন্টের ক্ষেত্রেও বড় ফান্ড দরকার। এ ছাড়া ক্লাইমেট ফান্ড ছাড়ের ক্ষেত্রেও আমাদের জটিলতায় পড়তে হয়। সে ব্যাপারেও কথা বলা উচিত।’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রায় প্রতিবছরই জলবায়ু সম্মেলনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে অনেকেই অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে আমি সমন্বয় দেখি না। সেটা থাকলে আমরা আমাদের বিষয়গুলো আরো ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারব।’

শেয়ার করুন