সম্প্রতি বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসবকে ঘিরে কুমিল্লায় সৃষ্ট একটি গুজবকে কেন্দ্র করে দেশের নানা স্থানে দুর্বৃত্তরা বিভিন্ন পূজামণ্ডপে হামলা চালিয়ে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ইমেজের যে ক্ষতি করেছে তা এককথায় অমার্জনীয়। এই ক্ষতিটা বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়েছে। জাতিসংঘ এই ব্যাপারে বাংলাদেশকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়ার কথা বলেছে। আসলে বিশ্বের যেখানেই সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরুর সমস্যা রয়েছে, সেখানেই এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সৃষ্টি হয় বা হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের কালো ও সাদাদের মধ্যে হানাহানি চলমান শত বছর ধরে। ইউরোপে নব্য নাৎসিবাদের উত্থান চোখে পড়ার মতো। বর্ণবাদও সেখানের কোনো কোনো দেশের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৭ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান যখন যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশে বসবাসরত জাপানি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকদের নিয়ে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে আটক করে রাখে। কভিড-১৯ সংক্রমণ যখন শুরু হয়, তখন কানাডায় কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাসরত চীনাদের দোকানে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ব্যাপারটা এমন—চীনের উহানে এই অতিমারির জন্ম, তাই কানাডার মানুষ ধারণা করে বসল যত নষ্টের মূল এই চীনারা। মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখে তাদের যদি জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা ভাষার ভিত্তিতে বিভাজন করা হয়, তখন সেখানে সাম্প্রদায়িকতার মতো একটি ভয়াবহ সমস্যা সৃষ্টি হতে বাধ্য। মিয়ানমারে সংঘটিত সাম্প্রতিক হানাহানি তার একটি বড় উদাহরণ। মালয়েশিয়া আমাদের কাছের দেশ। সেখানে সব ক্ষেত্রে দেশের আদি বাসিন্দাদের (ভূমিপুত্র) অগ্রাধিকার। সম্প্রতি আমার বাঙালি বন্ধু, যিনি সেই দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। যখন হাসপাতালে ভূমিপুত্রদের জায়গা হচ্ছিল না, তখন তাঁকে হাসপাতাল ছেড়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। সেখানে কয়েক দিন পর তিনি অনেকটা সঠিক চিকিৎসার অভাবে মারা যান। এটিও এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা—স্থানীয় ও বিদেশি। ভারতকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু সেই ভারত কি তাদের সেই সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছে? পারেনি। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো ধর্ম ও বর্ণের নামে নিয়মিত সংঘাত আর সন্ত্রাস হয়। ইরাক, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে এখনো শিয়া-সুন্নি বিভাজনের নামে নিয়মিত মসজিদে হামলা হয়, শত শত নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। অথচ আল্লাহর নবী কখনো এসব বিভাজনের সঙ্গে নিজেকে জড়াননি। ইসলামে এমন কোনো বিভাজনও নেই। তিনি সৃষ্টিকর্তার শান্তির বাণী প্রচার করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলমানদের হাতে যতসংখ্যক মুসলমান প্রাণ হারিয়েছেন, তা এককথায় অবিশ্বাস্য এবং তা এখনো চলমান।
বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর রাজনীতির প্রথম সবক নিয়েছিলেন মুসলিম লীগ নেতাদের কাছ থেকে। কে না জানে মুসলিম লীগের রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল সাম্প্রদায়িক। যদিও বলা হয় মুসলিম লীগের জন্ম এই ঢাকায়, ঢাকার নবাবদের হাত ধরে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এটা রাজনৈতিক দল হিসেবে জন্ম নেয়নি, নিয়েছিল ঢাকার নবাব ও অন্যান্য বনেদি পরিবারের স্বার্থ রক্ষার জন্য। পরে এটি যখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর খপ্পরে পড়ে, তা হয়ে ওঠে এক রাজনৈতিক দল এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে ওঠে মুসলমানদের দল; কারণ তত দিন এমন কথা চালু হয়ে গেছে যে ভারতে বসবাসরত হিন্দু আর মুসলমানরা দুটি জাতি, যদিও ভারতে সেই প্রাচীনকাল থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীসহ আরো একাধিক ধর্মের মানুষ বাস করে আসছে। কংগ্রেসের ইতিহাসটাও অনেকটা মুসলিম লীগের মতো। ১৮৮৫ সালে অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ আমলা অ্যালেন অক্টোবিয়াস হিউম ভারতীয় কংগ্রেস গঠন করেন ভারতীয় আর ইংরেজদের মধ্যে একটি সুসম্পর্কের আবহাওয়া তৈরি করার জন্য। পরবর্তীকালে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে গোপাল কৃষ্ণ গোখলে, বাল গঙ্গাধর তিলক, দাদাভাই নওরোজি, বিপিন চন্দ্র পাল, সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জি, মতিলাল নেহরু প্রমুখ ভারতীয় উচ্চবর্ণের নাগরিক সেই কংগ্রেসকে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড় করান। পরবর্তীকালে সেখানে এসে মহাত্মা গান্ধী যোগ দেন। জিন্নাহ যেমন মুসলিম লীগে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলেন, গান্ধীর বেলায়ও একই কথা সত্য। গান্ধী ভারতে আসার অনেক আগে থেকে জিন্নাহ কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। কিন্তু তিনি কংগ্রেসে তেমন একটা সুবিধা করতে না পেরে মুসলিম লীগকে দখল করে তার নেতা হয়েছিলেন।
সারা ভারতে একমাত্র অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগের অবস্থান ছিল শক্ত। এই বাংলায় মুসলিম লীগ বা মুসলমানরা এককভাবে বা অন্যান্য দলকে নিয়ে সরকার গঠন করেছে। এর একটি কারণ ছিল বাংলার নিম্নবিত্তরা হিন্দু বা মুসলমান যেই হোক না কেন, তারা বড় বড় হিন্দু জমিদারদের শোষণের শিকার হয়েছে। শিকার হয়েছে ইংরেজ নীলকরদের। এখানে জাতি বা ধর্মকে নিয়ে যত না মতভেদ ছিল তার চেয়েও বেশি সমস্যা ছিল ধনী-দরিদ্র বৈষম্য নিয়ে। বলা বাহুল্য, অবিভক্ত বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলানদের মুসলিম লীগ বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল তাদের একটি পৃথক স্বাধীন আবাসভূমি থাকলে তারা এই বৈষম্য থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। ছিন্নমূল নিরক্ষর মুসলমানরা এই কথা বিশ্বাস করে সব সময় মুসলিম লীগকে সমর্থন করেছে। যে টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের জন্ম, সেই টুঙ্গিপাড়ায়ও ছিল এমন সব ছিন্নমূল মুসলমান ও নিম্নবিত্ত সনাতনধর্মী মতুয়াদের বাস, যারা যুগ যুগ ধরে হিন্দু জোতদার আর জমিদারদের শোষণের শিকার হয়েছে।
তরুণ মুজিবের মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এই শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য ফেরানোর কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করা। সেখানে কে হিন্দু আর কে মুসলমান তা তেমন একটা বিবেচ্য বিষয় ছিল না। তরুণ মুজিবের জন্য ১৯৪৬-এর কলকাতার দাঙ্গা ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের একটি টার্নিং পয়েন্ট। তিনি দেখলেন কিছু রাজনীতিবিদের ব্যক্তিস্বার্থে কিভাবে শান্তিপ্রিয় বাঙালি জাতিকে স্রেফ গুজব রটিয়ে হিংস্র দানবে রূপান্তর করা যায়। এই দাঙ্গায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা হওয়ার আশঙ্কা আছে তাদের রক্ষা করার জন্য তিনি তাঁর সহপাঠীদের নিয়ে নেমে পড়লেন। এখানে কে হিন্দু আর কে মুসলমান তা কখনো বিবেচ্য ছিল না। বিবেচ্য ছিল মরছে মানুষ, তাদের বাঁচাতে হবে। সম্ভবত এই দাঙ্গাই ছিল বাংলায় প্রথম উগ্র ধর্মাশ্রিত রাজনীতির আত্মপ্রকাশ। এর জন্য সে সময় প্রায় সব সক্রিয় রাজনৈতিক দলকেই দোষারোপ করা যায়। মুসলিম লীগ, হিন্দু মহাসভা, কংগ্রেস—কোনো দলই এই দাঙ্গার দায় এড়াতে পারবে না। এটি এখনকার নির্মোহ ঐতিহাসিকদেরও মত। তরুণ শেখ মুজিব রাজনীতির অপর চিত্রটার সঙ্গে তখন পরিচিত হয়েছিলেন। এ যেমন বিশ্বখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের কথার প্রতিধ্বনি। তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্ম হচ্ছে আফিমের মতো’। মানুষ ধর্মের আদ্যোপান্ত না বুঝে যদি ধর্মকে নিয়ে খেলা করে, তখন মানুষ দানবে পরিণত হতে পারে। কলকাতার দাঙ্গার পর বিহার, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব প্রভৃতি এলাকায় এই দাঙ্গা ছড়িয়েছিল এবং তাতে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। মুজিব বুঝেছিলেন এই এক ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা রাতারাতি আপনকে পর করে দিতে পারে, আর পরকে আপন। তখন থেকেই মুজিব অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর শেখ মুজিব ও অনেক মুসলিম লীগ নেতা পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা দেখেছিলেন যখনই বাঙালিদের কোনো ন্যায্য দাবির প্রসঙ্গ ওঠে পাকিস্তানের শোষকগোষ্ঠী তখন কিভাবে মুখস্থ বলে দেয়—এসব দাবি করলে বা মানলে ইসলামের ক্ষতি হবে বা ইসলাম বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। এমন কথা শুধু যে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বলেছে তা নয়, তারা তাদের সঙ্গে পেয়েছে এ দেশের কিছু ধর্মান্ধ দল—জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপিকে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু স্বচক্ষে না দেখলেও পরে শুনেছেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কিভাবে ধর্মের নামে এ দেশে ৩০ লাখ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে এবং প্রায় তিন লাখ মা-বোনের ইজ্জতের হানি করেছে। এসব বন্ধ করার জন্যই তিনি ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে বাংলাদেশের অন্যতম চার মূলনীতির একটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে এসব বাতিল করে দেন এবং বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ ও ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে চেষ্টা করেছেন পিতার আদর্শকে ফিরিয়ে আনতে; কিন্তু পুরোপুরি সফল হয়েছেন বললে ভুল হবে। এখনো ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রত্যাবর্তনের কথা বললে তাঁর নিজ দলেরই একটি গোষ্ঠী লাফিয়ে ওঠে। তা করা যাবে না। যে আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হয়েছিল একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির দর্শন বাস্তবায়ন করার জন্য, সেই দলে নেতাকর্মীদের হাত ধরে স্রেফ দল ভারী করার জন্য অনেক চরম উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সতর্ক না হলে একসময় আওয়ামী লীগকেই তার জন্য চরম মাসুল দিতে হবে। যখন দেশের মানুষ শোনে—কুমিল্লার ঘটনা নিয়ে দেশের কয়েক জায়গায় আওয়ামী লীগের কিছু কর্মীও জড়িত ছিল, তখন যাঁরা বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার প্রত্যাশিত আওয়ামী লীগ দেখতে চান তাঁদের মাথাও হেট হয়ে যায়। এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার একমাত্র ভরসা হিসেবে আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষীরা শেখ হাসিনাকেই দেখেন। তা যদি তিনি করতে না পারেন তাহলে একসময় আওয়ামী লীগ আর জামায়াত-মুসলিম লীগের মধ্যে তেমন কোনো তফাত থাকবে না। তেমনটা যদি হয় তা হলে বঙ্গবন্ধু তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম যাদের হাতে আওয়ামী লীগ পরিচালনার দায়িত্ব পড়েছে, তাদের অভিশাপ দেবেন।
অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জয় হোক, বাঙালি সব সময় জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে বাঙালি থাকুক।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক