বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের মতো এত দুর্দশাগ্রস্ত খাত সম্ভবত আর একটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই পেশায় আসেন সমাজের সবচেয়ে মেধাবীরা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে ইদানীং কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটছে এ ক্ষেত্রে। দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ডাক্তারিতে ভর্তির অসংখ্য প্রমাণ মিলেছে। এ রকম একটা পেশার ক্ষেত্রে যা অকল্পনীয়। মাশরুমের মতো হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনসিস সেন্টারে ভরে গেছে আমাদের রাজধানী ঢাকাসহ শহরগুলো। এমনকি গ্রামগঞ্জে পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। সরকারের (বর্তমান) প্রতিষ্ঠিত ১৮-১৯ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক যথাযথভাবে চলছে না। জনবলের স্বল্পতা রয়েছে। রয়েছে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অপ্রতুলতা। সর্বোপরি ডাক্তার-নার্স-কম্পাউন্ডারদের কর্তব্যে অবহেলা, অনুপস্থিতি, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে যে উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার এগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিল তার সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে বা হচ্ছে। অনেকটা হতাশ ও বাধ্য হয়েই পল্লী এলাকার মানুষ শহরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দ্বারস্থ হয় প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য।
অপচিকিৎসা ও ভুল চিকিৎসার সংবাদ তো গণমাধ্যমে প্রতিদিনই দেখা যায়। এগুলোকে কেন্দ্র করে প্রায়ই মারামারি ও হানাহানির ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। তারপর মামলা, কোর্ট-কাচারি কত কী! এ তো গেল সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কেচ্ছা। এবারে আসা যাক বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের গল্পে। বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার সরকারি সিদ্ধান্তকে অপব্যবহার করে সারা দেশে মাশরুমের মতো অসংখ্য ক্লিনিং, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল, কলেজ ইত্যাদি গড়ে উঠেছে; কিন্তু এগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সেই শুরু থেকেই। কভিড-১৯ মহামারির সময়ে এসে এদের কুকীর্তির অসংখ্য ঘটনা বেরিয়ে এসেছে।
সরকারি-বেসরকারি-নির্বিশেষে সব হাসপাতালের পরিবেশের যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটাতে হবে। অবশ্যই উন্নত দেশের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। হাসপাতাল চত্বরকে ময়লা-আবর্জনামুক্ত রাখতে হবে সর্বক্ষণ। ডাক্তার ও নার্সদের আরো মানবিক আচরণ করতে হবে। দুর্নীতিকে চিরতরে বিদায় জানাতে হবে। সরকার প্রদত্ত অনুদানের বা বরাদ্দের প্রতিটি টাকার সদ্ব্যবহার করতে হবে। সিন্ডিকেট করে ভাগ-বাটোয়ারা চিরতরে বন্ধ করতে হবে। লেনদেন ও কেনাকাটায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। ইচ্ছাকৃত ভুল চিকিৎসা ও অবহেলাজনিত কারণে রোগীর মৃত্যু হলে সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে এ ক্ষেত্রে। উন্নত, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিদ্যমান আইনের অনুরূপ আইন আমাদের দেশেও অবশ্যই করতে হবে।
ব্যক্তিগত ব্যবসার লাগাম টানতে কঠোর আইন করতে হবে। বেসরকারি খাতে চিকিৎসার নামে যা হচ্ছে তা অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর পকেট কাটা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসার নামে হচ্ছে অপচিকিৎসা। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের সংশ্লিষ্টদের জন্য ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন’ এ নিয়ম বাস্তবায়ন করতে হবে। চিকিৎসাসেবার মানোন্নয়নে এর কোনো বিকল্প নেই। রক্ত-মাংসের মানুষের দৈহিক ও মানসিক শক্তির অবশ্যই সীমাবদ্ধতা আছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ ফলাফলের আলোকে রোগী দেখার ক্ষেত্রে সংখ্যা নির্ধারণ করে দিতে হবে।
আধুনিক সব যন্ত্রপাতি ব্যবহারে ও পরিচালনায় দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে সরকারি উদ্যোগে কাজটি করতে হবে। মেডিক্যাল টেকনোলজি ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে হবে।
উন্নত বিশ্বের (বিশেষ ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল বিশ্বেরও হতে পারে) দেশগুলোর বিখ্যাত চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতামূলক কর্মসূচি বা চুক্তিতে যেতে হবে। বেশি দূরে যেতে হবে না উদাহরণের জন্য। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিএম বিড়লা হার্ট সেন্টার (বেসরকারি) এবং কলকাতা মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিএমআরআই, সরকারি) যুক্তরাষ্ট্রের অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতামূলক চুক্তির আওতায় অত্যন্ত সফলভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর আধুনিকায়ন সম্পন্ন করেছে। এ অভিজ্ঞতা থেকে আমাদেরও শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। চিকিৎসাসেবার মান বৃদ্ধি করতে হলে এটা অবশ্যই করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক সভাপতি, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়