জেলহত্যা মামলা : ১১ আসামির ১০ জন আজও পলাতক

নিজস্ব প্রতিবেদক

মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা
মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা। ফাইল ছবি

বাঙালি জাতির ইতিহাসে কলঙ্কময় জেলহত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ৮ বছর পরও পলাতক আসামিদের সাজা কার্যকর হয়নি। ৪৬ বছর আগের এ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ার তিনটি ধাপ পার হলেও দণ্ডিত ১১ আসামির ১০ জন আজও পলাতক।

এদের ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ৮ জনের যাবজ্জীবন হয়। এর মধ্যে ৬ জন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়ও দণ্ডিত। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ওই খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কারা, সে বিষয়েও অনুসন্ধান চলছে।

universel cardiac hospital

দণ্ডিত ১১ জনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলো-রিসালদার মোসলেহ উদ্দীন, বহিষ্কৃত দুই সেনা সদস্য দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাসেম মৃধা। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা হলো- মেজর (অব.) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) কিসমত হাশেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমূল হোসেন আনসার, কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশীদ, লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম, ক্যাপ্টেন (অব.) এমবি নূর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ ও লে. কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আবদুল মাজেদের মৃত্যুদণ্ড গত বছর কার্যকর করেছে সরকার। মাজেদ ভারতে পলাতক ছিল।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন কোথায় আছেন সে ব্যাপারে সরকারের কাছে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। কেবল যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দু’জনের ব্যাপারে তথ্য আছে। তাদের মধ্যে কর্নেল (অব.) এমবি নূর চৌধুরী কানাডা এবং লে. কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তাদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে চেষ্টা চলছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর ওই বছর ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে। এমন হত্যাকাণ্ড পৃথিবীতে নজিরবিহীন।

এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা এবং পরে জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। রায় কার্যকর চলছে। পলাতক যারা বিদেশে আছেন, তাদের ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

মামলা ও বিচার

হত্যাকাণ্ডের পরদিন তৎকালীন ডিআইজি (প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় মামলা করেন। কিন্তু দীর্ঘ ২১ বছর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে জেলহত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত করে।

তদন্তভার দেয়া হয় সিআইডিকে। ২ বছর তদন্ত শেষে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহ্হার আকন্দ ১৯৯৮ সালের ২০ অক্টোবর ২০ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেন। এরপর ৬ বছরের বেশি সময় চলে বিচারকাজ। জেলহত্যার ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলার রায় ঘোষণা করেন।

উচ্চ আদালতে মামলার নিষ্পত্তি

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে হাইকোর্ট ২০০৮ সালে সৈয়দ ফারুক রহমান, শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও এ কেএম মহিউদ্দিনকে খালাস দেন। তবে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি হিসাবে এ চারজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

এদিকে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে হাইকোর্ট ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট এক রায়ে শুধু রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাসেম মৃধা এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপর চার আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।

হাইকোর্টে খালাসপ্রাপ্ত এ চারজনের ফাঁসি কার্যকর হয় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার ফের ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়। ফাঁসির তিন আসামির মধ্যে শুধু দু’জনকে খালাস দেওয়ায় রায়ের ওই অংশটির বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

সাবেক প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০১৩ সালে চূড়ান্ত রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ে খালাস পাওয়া দফাদার মারফত আলী ও এলডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।

২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর ওই রায়ের ২৩৫ পৃষ্ঠার অনুলিপি প্রকাশ পায়। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার লেখা ওই রায়ে বলা হয়, ‘এ মামলায় পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে যে, ২ নভেম্বর রাতে রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গে এ দুই আসামি কারাগারে ঢুকেছিলেন।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ৩ নভেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন। এমন হত্যাকাণ্ড পৃথিবীতে নজিরবিহীন। এ হত্যার বিচার হয়েছে, কিন্তু খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, না হলে আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

শেয়ার করুন