কোনো ইস্যু পেলেই জনগণকে জিম্মি করাটা যেন আমাদের দেশে এক ধরনের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে! রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন খাতের শ্রমিক কিংবা পরিবহন মালিক- তাদের দাবি আদায়ে বেছে নেন সড়কে অবস্থান ধর্মঘট নয়তো পরিবহন ধর্মঘট। এর ফলে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষকে কতটা ভোগান্তিতে পড়তে হয়- তা কি সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করেন না? রাষ্ট্রে সবারই সমঅধিকার; তাহলে একজনকে জিম্মি করে আরেকজনের অধিকার বা দাবি আদায় কতোটা যৌক্তিক?
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ করেই গণপরিবহন ও পণ্যবাহী যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে এ খাতের মালিক ও শ্রমিক সংগঠন কর্তৃক অনির্দিষ্টকালের জন্য বাস-ট্রাক চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে জনদুর্ভোগ বেড়েছে। এভাবে হঠাৎ সারা দেশে বাস ও ট্রাক চলাচল বন্ধ হওয়ায় সাধারণ যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন, যা বলাই বাহুল্য। বিশেষত গণপরিবহণ বন্ধের ঘোষণায় চাকরিপ্রার্থীরা চরম দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়েছেন। কারণ ৫ নভেম্বর অন্তত ১৯টি প্রতিষ্ঠানে চাকরির পরীক্ষা ছিল। তাছাড়া আগামী ১৪ নভেম্বর শুরু হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা। গণপরিবহণ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত প্রলম্বিত হলে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা যে দুর্ভোগে পড়বেন, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
হঠাৎ করে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক হয়েছে- এ প্রশ্ন যেমন আছে, তেমনি এর প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাস ও ট্রাক চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। যে কোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনাই উত্তম পন্থা নয় কি? পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা এ পথে অগ্রসর হলে জনভোগান্তির এ চিত্র আজ আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হতো না। বস্তুত বর্তমানে অবস্থা দাঁড়িয়েছে ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’র মতো। তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার, অথচ এজন্য দুর্ভোগের মুখে পড়েছে দেশের সাধারণ মানুষ, যা মোটেই কাম্য নয়।
ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম প্রত্যাহারের দাবিতে সরকারকে চিঠি দিয়েছেন পরিবহন মালিকরা। এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কী প্রতিক্রিয়া দেখায়- সে পর্যন্ত অবশ্যই তাদের অপেক্ষা করা উচিত ছিল। বাস ভাড়া বাড়ানোর জন্য তারা জনসাধারণকে জিম্মি করতে পারলেও রাজধানীতে ওয়েবিলের নামে যে নৈরাজ্য বা সন্ত্রাস চলছে সেই বিষয়ে তারা কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধানে এগিয়ে আসছেন না কেন? ওয়েবিল সই হওয়ার পর একহাত দূরত্বে কোনো যাত্রী নামতে গেলেও তাকে নির্দিষ্ট ভাড়া পরিশোধে বাধ্য করা হয়। অথচ ওয়েবিল সই হওয়ার পরও সারাপথে লোকাল বাসের মতো যাত্রী উঠানো হয়। এমনটি কোন আইনে হচ্ছে? এসব দেখার কি কেউ নেই?
যে কোনো দাবি-দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে দেশের জনগণকে জিম্মি করার প্রবণতা বা সংস্কৃতির চর্চা দীর্ঘদিন ধরে চালু রয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। নিয়মমাফিক আলোচনার মধ্য দিয়েই সব সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হওয়ার মতো কোনো সিদ্ধান্ত বা কর্মসূচি কাম্য নয়। সরকারেরও উচিত জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। সংশ্লিষ্ট সবাই এ ব্যাপারে সুবিবেচনার পরিচয় দেবেন, এমনটিই প্রত্যাশা।
লেখক : কবি ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক