ঋণ জালিয়াতির মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এই সাজা দেওয়া হয় বলে জানান বিচারক। রায়ে আদালত পর্যবেক্ষণও দিয়েছেন।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম রায় ঘোষণার সময় পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের টাকাগুলো সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার ব্যাংক অ্যাকাউন্ডে অসৎ উদ্দেশ্যে আসে। লোন প্রক্রিয়া ছিল বেআইনি। এই লোনের প্রধান সুবিধাভোগী হচ্ছেন এসকে সিনহা। তিনিসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদক যে অভিযোগ এনেছে তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।’
এর আগে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মামলার অন্যতম আসামি ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতিকে (বাবুল চিশতি) কাশিমপুর কারাগার থেকে একটি প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে আনা হয়। এছাড়া আদালতে উপস্থিত হন জামিনে থাকা ছয় আসামি।
বেলা সোয়া ১১টায় ১৮২ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু করেন বিচারক। দুপুর সোয়া একটার দিকে রায় পড়া শেষ হয়।
রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের দায়ে ৪ বছর এবং মানিলন্ডারিং ধারায় ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে দুটি সাজা একসঙ্গে চলার কারণে সাবেক এই প্রধান বিচারপতিকে সাত বছর জেল খাটতে হবে বলে জানিয়েছেন আদালত।
রায়ে এস কে সিনহার ৭৮ লাখ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে অপর ১০ আসামির মধ্যে দুজনকে খালাস এবং একজনকে চার বছর এবং অপর সাতজনের তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
এর আগে দুই দফা রায় ঘোষণা পেছানো হয় আলোচিত মামলাটির। ৫ অক্টোবর বিচারক অসুস্থ থাকায় এবং ২১ অক্টোবর বিচারক রায় প্রস্তুত করতে না পারায় তা পেছানো হয়।
গত বছর ১৩ আগস্ট ১১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ নাজমুল আলম। অভিযোগপত্রে নাম থাকা ২১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় গত ২৪ আগস্ট। এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়।
ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ব্যবসায়ী পরিচয়ে দুই ব্যক্তির নেওয়া ঋণের চার কোটি টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়েছিলেন আলোচিত বিচারপতি এস কে সিনহা। বিষয়টি টের পেয়ে তদন্তে নামে দুদক। দীর্ঘ তদন্তের পর ২০১৯ সালের ১০ জুলাই সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন।
মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় আলাদা দুটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য পরদিন তারা ওই ব্যাংক থেকে দুই কোটি টাকা করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ঋণের আবেদনে উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৫১ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, যার মালিক ছিলেন তখনকার প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা।
ঋণের জামানত হিসেবে আসামি রনজিৎ চন্দ্রের স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামে সাভারের ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয় ঋণের আবেদনে। ওই দম্পতি এসকে সিনহার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার এজাহারে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ৭ নভেম্বর ঋণের আবেদন হওয়ার পর অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে তা অনুমোদন করা হয়। পরদিন মোট চার কোটি টাকার দুটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয় এস কে সিনহার নামে। ৯ নভেম্বর সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এস কে সিনহার অ্যাকাউন্টে জমা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে এসকে সিনহার ভাইয়ের নামে শাহজালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার অ্যাকাউন্টে দুটি চেকে দুই কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয় ওই বছরের ২৮ নভেম্বর।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে সেই টাকা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর, উত্তোলন ও পাচার করেছেন, যা দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২)(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।