আহসানউল্লাহ থেকে ব্যাংকের প্রশ্নফাঁস, চক্রের ৫ জন ধরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির অধীনে পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাঁস হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন, বিভিন্ন ব্যাংকের তিনজন কর্মকর্তা ও একজন পরীক্ষার্থীসহ এই চক্রের পাঁচজনকে ধরেছে গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের কাছ থেকে প্রশ্ন পেয়েছে এমন অন্তত দুই শ পরীক্ষার্থীর নামও মিলেছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার এসব তথ্য জানিয়ে বলেছেন, চক্রটি চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে প্রায় ৬০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

universel cardiac hospital

রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে বুধবার সন্ধ্যায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ চক্রের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরে গোয়েন্দা পুলিশ।

এ কে এম হাফিজ আক্তার জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের একজন আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি টেকনেশিয়ান প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁসের মূলহোতা মোক্তারুজ্জামান রয়েল, জনতা ব্যাংকের গুলশান শাখার অফিসার শামসুল হক শ্যামল, রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলন, পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলন ও পরীক্ষার্থী রাইসুল ইসলাম স্বপন।

তাদের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ, বিভিন্ন মডেলের পাঁচটি মোবাইল, চারটি প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র, হোয়াটস অ্যাপে-এ রক্ষিত উত্তরপত্রের ছবি, একটি প্রবেশপত্রের ফটোকপি ও নগদ ছয় লাখ টাকা জব্দ করা হয়।

ডিবি প্রধান বলেন, ৬ নভেম্বর বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে পাঁচটি ব্যাংকের ১৫১১টি অফিসার ক্যাশ পদে নিয়োগ পরীক্ষা হয়। ওইদিন বিকাল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র তৈরি ও পুরো পরীক্ষা সম্পাদনের দায়িত্বে ছিল আহসানুল্লাহ ইউনির্ভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি।

হাফিজ আক্তার বলেন, ডিবির তেজগাঁও জোনাল টিম জানতে পারে এই পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হবে। এমন তথ্য আসার পর ডিবি পুলিশ পরীক্ষার্থী ছদ্মবেশে পরীক্ষার দিন সকাল ৭ টায় প্রশ্নপত্রসহ উত্তর পাওয়ার জন্য চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের অন্যহোতা রাইসুল ইসলাম স্বপনকে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করা হলে পরীক্ষার্থীকে বুঝে নিয়ে যায়। এরপর পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ স্বপনকে হাতেনাতে আটক করা হয়। ৬ নভেম্বর পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের সঙ্গে সকালে পাওয়া প্রশ্ন ও উত্তর হুবহু মিলে গেলে স্বপনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রূপালী ব্যাংকের সাভার শাখার শ্রীনগর থেকে জানে আলম মিলনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার (জানে আলম মিলন) তথ্যের ভিত্তিতে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অভিযান চালিয়ে জানা যায়, প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র সরবরাহকারী শামসুল হক শ্যামল ঢাকায় অবস্থান করছেন। ঢাকার দক্ষিণ বাড্ডা থেকে শামসুল হক শ্যামলকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ।

ডিবিপ্রধান বলেন, শ্যামলকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রশ্নপত্রসহ উত্তরপত্র ফাঁস করার কথা স্বীকার করেছে। তার দেওয়া তথ্যে চক্রে মূলহোতা মুক্তারুজ্জামান রয়েলকে বাড্ডার আলিফনগর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। মুক্তারুজ্জামান আহসানউল্লাহ ইউনির্ভাসিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজিতে আইসিটি বিভাগে কর্মরত। তিনি বিশ্ববিদ্যালেয়ে কর্মরত অন্যান্য সহযোগীদের সহায়তায় প্রশ্ন ও উত্তরপত্র সংগ্রহ করেছে বলে স্বীকার করেছেন। এছাড়া রয়েলের মোবাইলে থাকা হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর লালবাগ থেকে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলনকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রশ্নপত্র ফাঁস সম্পর্কে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, পরীক্ষার আগে চক্রের সদস্যরা রাজধানীর বাড্ডা, বসুন্ধরা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, রূপনগর, মিরপুর, মাতুয়াইল, শেওড়াপাড়া, শেরেবাংলানগর, পল্লবী এলাকায় বুথ বসায়। যেখানে পরীক্ষার ৫/৬ ঘণ্টা আগে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্ন ও উত্তরপত্র মুখস্থ করানো হয়। চক্রের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক বুথে ২০/৩০ জন পরীক্ষার্থীর পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করিয়ে কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

ডিবির প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মুক্তারুজ্জামান ও শ্যামল জানিয়েছে, সু-কৌশলে তারা আগেও তিনটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁস করেছে। পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হতো। এমসিকিউ পরীক্ষার আগে ২০ শতাংশ, লিখিত পরীক্ষার আগে আরও ২০ শতাংশ ও নিয়োগ পাবার পর বাকি ৬০ শতাংশ টাকা পরিশোধের শর্তে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে চুক্তি করে ডেকে নেওয়া হতো।

২০০ জন পরীক্ষার্থীর নাম পাওয়া গেছে:

মহানগর ডিবি প্রধান বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ১১টি বুথ এই চক্রের ২৫/৩০ জনের নাম এবং প্রায় ২০০ জন পরীক্ষার্থীর নাম পেয়েছি। মোক্তারুজ্জামান রয়েল প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁসের মূল হোতা। মোক্তারের কাছ থেকে প্রশ্ন নিয়ে শামসুল হক শ্যামল বিভিন্ন বুথে সরবরাহ করে। জানে আলম মিলন বিভিন্ন পরীক্ষার্থী সংগ্রহ ও বুথ নিয়ন্ত্রণ করে। পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করায়। অর্থেও মাধ্যমে প্রশ্ন ও উত্তর প্রদান করে। মোস্তাফিজুর রহমান মিলন পরীক্ষার্থী এবং বুথ নিয়ন্ত্রণ করে। পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করায়। অর্থের মাধ্যমে প্রশ্ন ও উত্তর প্রদান করে। স্বপন পরীক্ষার্থী। সেও প্রশ্ন ও উত্তরপত্র সংগ্রহ এবং বুথ নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থের মাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ও উত্তর প্রদান করে। এ পর্যন্ত এই চক্রের সনাক্ত সদস্য সংখ্যা ২৫/৩০ জন বলে জানা গেছ। বিগত সময়ে অনুষ্ঠিত ব্যাংকের ৩টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছিল বলে তথ্য মিলেছে।

এক প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, এই প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে আহসান উল্লাহসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই চক্রে আর যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান রয়েছে।

শেয়ার করুন