জাতির কলঙ্কমুক্তির দিন

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। ছবি : সংগৃহীত

আজ ১২ নভেম্বর। দেশের ইতিহাসে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল দিবস। ‘ইনডেমনিটি’ শব্দের অর্থ হচ্ছে শাস্তি এড়ানোর ব্যবস্থা।

এখানে শাস্তি এড়ানো বলতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি এড়ানোর ব্যবস্থার কথা বোঝানো হয়। অর্থাৎ, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ হলো সেই অধ্যাদেশ, যে অধ্যাদেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি এড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে শাস্তি এড়ানোর জন্য বাংলাদেশে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছিল, যা দেশের ইতিহাসে ডার্কেস্ট ল’ বা সবচেয়ে কালো আইন নামে পরিচিত।

১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে খন্দকার মোশতাক হন দেশের রাষ্ট্রপতি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গবন্ধুর খুনি ও তাদের দোসররা নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানের হত্যাকে আইনসিদ্ধ করতে চেয়েছিল। তাই তখন খুনিদের ‘প্রয়োজনে’ জারি করা হয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। যেহেতু তখন দেশে সংসদ অধিবেশনে ছিল না, তাই খন্দকার মোশতাক আহমেদ কর্তৃক ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর একটি অধ্যাদেশের আকারে এ আইনটি প্রণীত হয়; যা ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নম্বর ৫০ নামে অভিহিত ছিল।

১৯৭৯ সালে সংসদ কর্তৃক ওই ইনডেমনিটি অনুমোদন করা হয়। ফলে তা তখন আনুষ্ঠানিকভাবে আইন হিসাবে অনুমোদন পায়। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এ আইনটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া একেবারে বন্ধ হয়ে যায়; যা ছিল দেশের ইতিহাসের দুঃখজনক একটি ঘটনা।

পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামক ইতিহাসের কালো আইনটি বাতিল করা হয়। এর ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ সুগম হয় এবং ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাইকোর্ট কর্তৃক সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে আবির্ভূত হন। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল জিয়াউর রহমান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সায়েমের কাছ থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে নেন। এরপর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করান এবং তিনি রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল ‘সংবিধান (সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’। এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত হয়েছিল। বলা বাহুল্য, তখন পঞ্চম সংশোধনীকে বৈধতা না দিলে জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যেত।

কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে রূপান্তর করে জিয়াউর রহমান প্রমাণ করেছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষাকারী। মূলত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের অর্থ হচ্ছে ষড়যন্ত্রকারীরা খুনের দায়ে কোনো আদালতে বিচারের সম্মুখীন হবে না; কারণ তারা যে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে তা ‘ঐতিহাসিক প্রয়োজনে’ ঘটিয়েছিল। এ ধরনের আইন মানবসভ্যতার জন্য কলঙ্কজনক হলেও এ দেশে এ আইনই ঘোষণা করা হয়েছিল।

কালো এ অধ্যাদেশটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। অধ্যাদেশটির দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবে, তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। এ সময় সংবিধানের গণতন্ত্র বিষয়টি খর্ব হবে বলে অনেকে বিরোধিতা করলেও রাষ্ট্রপতি তখন একক ক্ষমতা বলে সংশোধনী বিলটি পাস করান। খুনিদের বিচার থেকে মুক্তি দেওয়াই শুধু নয়, খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম দুইজন খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান এবং আবদুর রশিদ খোন্দকারকে মেজর থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি দেয়। তাছাড়া ১৯৭৫ সালের ৩ অক্টোবর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট মোশতাক বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকারী এ দুইজন সেনা কর্মকর্তাকে ‘সূর্যসন্তান’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিল।

বহুল আলোচিত এ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ স্বাক্ষরিত হওয়ার দিনটি ছিল শুক্রবার। ‘দ্য বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে স্বাক্ষরিত হয়েছে খন্দকার মোশতাক কর্তৃক আর তার স্বাক্ষরের পরে অধ্যাদেশটিতে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এমএইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান পঞ্চম সংশোধনী বিলটি পেশ করেছিলেন।

জিয়াউর রহমানের মৃত্যু-পরবর্তী সময়গুলোতে বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচএম এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও কুখ্যাত ওই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা প্রকাশ্যে বলে বেড়াত। এরশাদ ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল না করে তার নিজের সুবিধার জন্য দ্বিতীয়বার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন, যা ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় এবং সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত এরশাদ সরকারের জারিকৃত সব ধরনের সামরিক আইন, অধ্যাদেশ, বিধিনির্দেশ ইত্যাদি বৈধতাদানের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। পরে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি বিল ২০০৩’ নামে সর্বশেষে ইনডেমনিটি আইন পাস হয়।

২০১০ সালে এসব অধ্যাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। কারণ, তা ছিল অবৈধ, লজ্জাজনক ও কলঙ্কজনক। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, ভারতে মহাত্মা গান্ধী, রাজিব গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানে বেনজীর ভুট্টো, শ্রীলংকার সিরিমাভো বন্দর নায়েককে গুলি করে হত্যা করা হলেও ওইসব দেশে ইনডেমনিটি আইন জারি করা হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে। পৃথিবীর কোনো আইনে বা সংবিধানে লেখা নেই যে, খুনিদের বিচার করা যাবে না।

অথচ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও কোনো রাষ্ট্রপতি বা সরকারপ্রধান কর্তৃক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল করা হয়নি, উলটো নিজেদের সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য ইনডেমনিটি বহাল রাখা হয়, যা দুঃখজনক। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিল বাতিলের জন্য ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬’ নামে সংসদে একটি বিল উত্থাপন করেন।

অবশেষে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হয়। পরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়। এর আগে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকার (যারা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির সমর্থক) ক্ষমতায় এলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভের পর আওয়ামী লীগ সরকার আবার ওই বিচারকার্য চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে লিভ-টু-আপিল-এর মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আপিল শেষে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন মহামান্য আদালত।

২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর পাঁচ ঘাতকের ফাঁসি কার্যকর করা হয় আর গত বছরে ভারতের কলকাতা থেকে ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ ঢাকায় এলে ধরা পড়ে এবং তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

কিন্তু এখনো বঙ্গবন্ধু হত্যার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামি পলাতক রয়েছে। বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করবে-কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের এ দিনে এটিই জাতির প্রত্যাশা।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটিং স্কলার, চন্ডীগড় ইউনিভার্সিটি (পাঞ্জাব, ভারত)

শেয়ার করুন