স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন কপ ২৬ সমাপ্ত হয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহের আলোচনার পর অসন্তোষ থাকলেও, শেষ মুহূর্তে মতৈক্য হয়েছে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর। স্থানীয় সময় গত শনিবার রাতে এক চুক্তিতে প্রায় ২০০টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে। জিইয়ে রেখেছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দ্রুত কমিয়ে আনার প্রত্যাশা।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে কথা
গ্লাসগো চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমাতে ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখতে প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেশগুলোকে আগামী বছরের মধ্যে শক্তিশালী পরিকল্পনা প্রকাশ করতে বলা হয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রে দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণের সুনির্দিষ্ট মাত্রা ঠিক করে দিতে ব্যর্থ হয়েছে গ্লাসগো সম্মেলন।
এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা না গেলে সমুদ্রসীমার উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে খরা, ঝড়, দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনাও। কপ ২৬-এর চেয়ারম্যান ও ব্রিটিশ মন্ত্রী অলোক শর্মা বলেন, ‘আমরা যদি প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারি, তবেই নিজেদের রক্ষা করতে পারব।’
কয়লার ব্যবহার নিয়ে অসন্তোষ
এবারের জলবায়ু সম্মেলনে প্রথমবারের মতো দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে কয়লার ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধের বিষয়ে জোর দিতে সফল হননি আলোচকেরা। বরং শেষ মুহূর্তে এই বিষয়ে ছাড় দিয়ে কয়লার ব্যবহার কমানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে চূড়ান্ত চুক্তিতে কয়লার ব্যবহার কমানো বা ‘ফেজ ডাউন’ করার ভাষাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগের খসড়ায় তা বন্ধ করা বা ‘ফেজ আউট’ করার কথা ছিল। ভারতের পক্ষ থেকে এ পরিবর্তনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। এমন পরিবর্তনে অসন্তোষ জানিয়েছে সুইজারল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ।
ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিরোধ
ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে জলবায়ু তহবিলে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি। ফলে অনেক উন্নয়নশীল ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অভিযোজন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে পিছিয়ে রয়েছে। গ্লাসগোর চূড়ান্ত চুক্তিতে ২০২৫ সালের মধ্যে ধনী দেশগুলোকে জলবায়ু তহবিলে বরাদ্দের পরিমাণ অন্তত দ্বিগুণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
কার্বন নিঃসরণের দায়
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। তবে বেশি বেশি কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে এর পেছনে দায়ী ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো। চূড়ান্ত চুক্তিতে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ ও কোম্পানিগুলোকে দায় মেটাতে অর্থায়ন করতে বলা হয়েছে। এসব অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোয় বনের ধ্বংস ঠেকানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে গৃহীত নানা উদ্যোগের বাস্তবায়নে ব্যয় করা হবে।
আরও নানা চুক্তি
গ্লাসগোয় মূল সমঝোতার বাইরে আরও কয়েকটি চুক্তি সবার নজর কেড়েছে। এবারের সম্মেলনে জাতিসংঘ ও ইউনিয়নের নেতৃত্বে প্রায় ১০০টি দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে মিথেন গ্যাসের নির্গমন গত বছরের মাত্রার তুলনায় ৩০ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দুটি দেশ—যুক্তরাষ্ট্র ও চীন জলবায়ু পরিবর্তন রোধে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে একমত হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা গ্যাসোলিনচালিত গাড়ি উৎপাদন বন্ধ, আকাশপথে ভ্রমণে কার্বন নিঃসরণ কমানো, বন রক্ষার মতো টেকসই উদ্যোগে অর্থ লগ্নি না করতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে।