বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) বলছে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাত দুর্নীতির উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। সবচেয়ে কম ঝুঁকিতে রয়েছে নিউজিল্যান্ড। মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) গভর্নমেন্ট ডিফেন্স ইন্টিগ্রিটি ইনডেক্স (জিডিআই) বা সরকারি প্রতিরক্ষা শুদ্ধাচার সূচক ২০২০ প্রকাশ করে সংস্থাটি বলছে, প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ‘অতি দুর্বল’। ৮৬টি দেশ নিয়ে প্রকাশিত এ সূচক অনুযায়ী ৬২ শতাংশ দেশেরই প্রতিরক্ষা খাত উচ্চ থেকে সংকটজনক দুর্নীতির ঝুঁকিতে রয়েছে।
মঙ্গলবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক বিজ্ঞপ্তিতে টিআইয়ের এই সূচকের ফলাফল তুলে ধরা হয়।
সূচকে বাংলাদেশের ফলাফলে উদ্বেগ প্রকাশ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ সূচক বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতি বিরাজ করছে—এমন কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ দিচ্ছে না। তবে খাতটিতে শুদ্ধাচার ঘাটতি ও দুর্নীতির ব্যাপক ঝুঁকির ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করেছে।
একটি দেশের সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে সার্বিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও কাঠামোতে দুর্নীতির ঝুঁকি কতটা, ঝুঁকি কমাতে কী ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক নীতিকাঠামো ও চর্চা আছে এবং সেগুলো কতটা কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক—এসব বিবেচনা করে এ সূচক প্রকাশ করা হয়েছে।
৭৭টি প্রশ্নের বিপরীতে ২১২টি নির্দেশকের ভিত্তিতে একটি দেশের প্রতিরক্ষা খাতের পাঁচটি ঝুঁকির ক্ষেত্র বিশ্লেষণ করে জিডিআই ২০২০ সূচকটি তৈরি হয়েছে। এ পাঁচটি ঝুঁকির ক্ষেত্র হলো: রাজনৈতিক, আর্থিক, জনবল, পরিচালনা এবং ক্রয়। এসব ক্ষেত্রে একটি দেশের প্রাপ্ত নম্বর (০ থেকে ১০০ স্কেলে) ‘এ’ থেকে ‘এফ’ শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা হয়েছে। ‘এ’ শ্রেণি হলো সবচেয়ে কম ঝুঁকিসম্পন্ন এবং ‘এফ’ শ্রেণি হলো সংকটজনক দুর্নীতির ঝুঁকিসম্পন্ন। সূচকের ফলাফল বলছে, ৮৫ স্কোর করে প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতির সবচেয়ে কম ঝুঁকিতে রয়েছে নিউজিল্যান্ড। এরপরই রয়েছে যুক্তরাজ্য ও নরওয়ে (স্কোর ৭৬), বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের (স্কোর ৭৩)। আর ৫ স্কোর করে সর্বোচ্চ সংকটজনক দুর্নীতির ঝুঁকিতে রয়েছে সুদান। এরপরেই রয়েছে মিসর (স্কোর ৬), মিয়ানমার ও আলজেরিয়া (স্কোর ৮) এবং ইরাক (স্কোর ৯)। টিআই বলছে, জিডিআই সূচকে কম নম্বর পাওয়া দেশগুলোতে প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে থাকা সুরক্ষাপদ্ধতি বা কার্যক্রম দুর্বল কিংবা অস্তিত্বহীন। একই সঙ্গে এসব দেশ অস্থিতিশীল, সংঘাতপূর্ণ কিংবা তার জনগণ শোষণের শিকার।
বাংলাদেশের স্কোর ২৫
সার্বিকভাবে ২৫ স্কোর করে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাত এ সূচকে দুর্নীতির অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। সূচকে বিচার্য পাঁচটি ঝুঁকি ক্ষেত্রের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি স্কোর করেছে সামরিক জনবল ব্যবস্থাপনায়—স্কোর ৫২। আর সবচেয়ে খারাপ স্কোর ০ (শূন্য) পেয়েছে পরিচালনা ঝুঁকির ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক ঝুঁকিতে স্কোর ২৬, আর্থিক ঝুঁকিতে স্কোর ১৯ আর সামরিক ক্রয়ে দুর্নীতির ঝুঁকিতে স্কোর ২৯।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সূচকের ফলাফলকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষা শুদ্ধাচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এবং তার মাধ্যমে সম্ভাব্য দুর্নীতির প্রতিরোধক সক্ষমতা কাঠামো সুদৃঢ় করা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে প্রথম ও অতিগুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে একটি অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ২০১০–এর ধারাবাহিকতায় একটি প্রতিরক্ষা শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়ন ও তার চর্চা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে খসড়া প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট খাতে বিশেষজ্ঞজনের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের মতো সব অংশীজনকে সম্পর্কিত করলে এর গ্রহণযোগ্যতা ও জাতীয় মালিকানাবোধ বাড়বে।
জিডিআইয়ের ফলাফল বলছে, বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকির কথা বলে প্রতিরক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং সেগুলোর পরিচালনা কার্যক্রম গোপনে পরিচালনার যে রীতি অনুসৃত হয়ে আসছে, তা মোটেই সঠিক নয়। বরং গোপনীয়তা কোনোভাবেই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তার জন্য প্রযোজ্য শর্ত নয়, এটি মূলত একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। যেমন নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য জিডিআই সূচকে উচ্চ স্কোর করেছে। এটি প্রমাণ করে যে একটি দেশের সরকার যত বেশি অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালিত হয়, সেখানে প্রতিরক্ষা খাত তত বেশি স্বচ্ছ এবং দুর্নীতির ঝুঁকিও কম। একইভাবে জিডিআই স্কোরের সঙ্গে ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্সের তুলনা বলছে, যারা উন্মুক্ত সরকারের সূচকে ভালো ফল করেছে, তারা প্রতিরক্ষা খাতের স্বচ্ছতায়ও বেশি নম্বর পেয়েছে।
জিডিআই সূচকের বিশ্লেষণ বলছে, সামরিক বা প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি এবং এ খাতের দুর্বল শাসন বা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত। এ ক্ষেত্রে জিডিপির ১ ভাগ সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি মানে জিডিআই স্কোর ৫ পয়েন্ট কমে যাওয়া। এটি প্রমাণ করে যে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি দুর্বল শাসনের ক্ষেত্রে হয়তো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ভূমিকা রাখে। যেটি বিদ্যমান পরিস্থিতি, বিশেষ করে শাসনব্যবস্থার দুর্বলতাকে ব্যবহার করে দুর্নীতির সুযোগ বা ঝুঁকি তৈরি করে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, এটি খুবই হতাশাজনক যে বিশ্বে সামরিক ব্যয় এখন বার্ষিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা দুর্নীতির মাত্রা ও ব্যাপকতাকে বাড়িয়ে চলেছে।
জিডিআইয়ের তথ্য বলছে, ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্যের ৮৬ ভাগই হয়েছে সেসব দেশ থেকে, যেসব দেশের প্রতিরক্ষা খাত মধ্যম থেকে উচ্চ দুর্নীতির ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে। শীর্ষ পাঁচ রপ্তানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র (৫৫), রাশিয়া (৩৬), ফ্রান্স (৫০), জার্মানি (৭০) এবং চীন (২৮)। এই পাঁচ দেশ বিশ্ব অস্ত্র বাণিজ্যের ৭৬ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে। আবার বিশ্বের মোট অস্ত্র আমদানির ৪৯ শতাংশের গন্তব্যই ছিল প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতির ‘উচ্চ’ থেকে ‘সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ দেশগুলোতে।