প্রায় নয় বছর ধরে মাকে দেখি না। সবাই মায়ের হাত ধরে স্কুলে যায়। আমি সেটা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। মা আসবে জেনে দুই বছর ধরে অপেক্ষায় আছি। আজ সেই অপেক্ষা ফুরাতে যাচ্ছে- কথাগুলো বলছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী শিফা মণি। বৃহস্পতিবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে কথা হলে এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন। দুপুরে ভারত থেকে আসা মা রীনা আক্তারকে কাছে পেয়ে আবেগে কান্না করে দেন শিফা মণি।
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার ডরিজাতপুর গ্রামের মানিক মিয়া ছেলে মো. শাহজাহান আসতেছি বলে বছর তিনেক আগে এক রাতে বাড়ি থেকে বের হন। সেই থেকে তার খোঁজ পাচ্ছিল না পরিবার। অবশেষে শাহজাহান বৃহস্পতিবার বাড়ি ফিরেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে দেশে আসেন।
রীনা আক্তার ও শাহজাহানের মতো ছয় বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে বাংলাদেশের আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে তারা বাংলাদেশে আসেন।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার চরকালি বাজাইল গ্রামের আলপনা খাতুন, বগুড়ার দুপচাচিয়া উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের জিয়ারুল ইসলাম, জামালপুর জেলা সদরের নারিকেলি গ্রামের মানিক মিয়া, ঢাকার কেরাণিগঞ্জের রিনা আক্তার, কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের ভাস্কর টিলা গ্রামের হানিফা আক্তার, বগুড়ার দুপচাচিয়া উপজেলার জিয়ারুল ইসলাম। ত্রিপুরায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের সহযোগিতায় ওই ৬ জনকে বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।
বেলা একটায় আখাউড়া স্থলবন্দরের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে তাদেরকে ভারত থেকে দেওয়ার সময় ভারতের ত্রিপুরাস্থ বাংলাদেশ সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ জুবায়েদ হোসেন, প্রথম সচিব ও দূতালয় প্রধান এস এম আসাদুজ্জামান, প্রথম সচিব মো. রেজাউল হক-সহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুমানা আক্তার, বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান, আখাউড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. সাইফুল ইসলাম, আখাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মিজানুর রহমান, ইমিগ্রেশন পুলিশের ইনচার্জ মো. আব্দুল হামিদ, স্বেচ্ছাসেবক সৈয়দ খায়রুল আলম ও ভারত থেকে আসা ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা।
একাধিক নথিপত্র সূত্রে জানা গেছে, ফেরত আসা ছয় বাংলাদেশিই মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ত্রিপুরায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হতে আটক হন। পরে আদালতের নির্দেশে আগরতলার মর্ডান সাইক্রিয়াট্রিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এদের অনেকেই এই হাসপাতালে চার থেকে পাঁচ বছর বা আরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ার পর তাদের দেশে ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই হাসপাতালে পাচারের শিকার আরো অনেক বাংলাদেশি আছেন বলে জানা গেছে।
উদ্ধারকৃত একজন জিয়ারুলের আত্মীয় মোহাম্মদ রাজ্জাক জানান, ২০১৪ সালে তার স্ত্রীর বোনের স্বামী জিয়ারুল নিখোঁজ হয়ে যান। তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। এমন একজন মানুষ কীভাবে ভারতে পাচার হলেন সেটা নিয়ে তারাও বিস্মিত।
আলপনার চাচাত ভাই দুলাল জানান, ১০ বছর আগে হঠাৎ করে একদিন তাদের বোন নিখোঁজ হন। অনেক পরে পুলিশের মাধ্যমে জানতে পারেন আগরতলায় মানসিক হাসপাতালে আছেন। কিন্তু কীভাবে গেল আমরা বুঝতে পারছি না।
হানিফা আক্তার ছেলে ইয়াছিন জানান, পাঁচ বছর আগে হঠাৎ করে তাদের মা হারিয়ে যান। তারা ভেবেছিলেন কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে গেছেন। পরে নানাবাড়ি করিমগঞ্জ থানায় খোঁজ করেন। কিন্তু পাননি। পরে মে মাসে পুলিশ খোঁজ নিতে বাড়িতে এলে জানতে পারেন আগরতলায় আছেন তার মা।
কেরাণিগঞ্জ উপজেলার কলাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. তাহের আলী বলেন, একটি আনন্দের ঘটনার সাক্ষী হতে এসেছি। বছর দুয়েক আগে খবর পাই রীনা আক্তার ভারতে আছেন। এরপর সরকারি উদ্যোগে তাদেরকে দেশে আনা হয়।
পরিবারের কাছে হস্তান্তরের পর ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে পাচারের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারবর্গের জরুরি অর্থ সহায়তা এবং কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করা হয় বলে জানান বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, তারা কীভাবে সেখানে গেলো সে বিষয়টি ভাবনার। তারা পাচারের শিকার হয়েছেন বলেও তিনি ধারণা পোষণ করেন।