একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধারা যে দলেরই হোক না কেন সবাই প্রকৃত সম্মান পাবেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দেওয়া সকলের কর্তব্য।
আজ রোববার সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত নির্বাচিত মুক্তিযোদ্ধা/তাঁদের উত্তরাধিকারদের সংবর্ধনা প্রদান এবং ২০২০-২০২১ সালের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ শান্তিকালীন পদক প্রদান অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করেছে। একসময় পরিচয় দিতে লজ্জা পেতো। আমরা সরকারে আসার পরে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করি। কারণ তাঁরা সম্মানিত। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পরিবার-পরিজন ছেড়ে দিয়ে বাংলার মানুষকে মুক্ত করবার জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছে। তাই সম্মান দেওয়া আমাদের কর্তব্য বলে আমি মনে করি।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁদের চিকিৎসার বিশেষ সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের ছেলে-মেয়েদের চাকরির ক্ষেত্রে বিশেষ কোটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছেলে-মেয়ে, পরিবার-পরিজন যেন চাকরিতে নিয়োগ পায় সেই ব্যবস্থাটাও আমরা করে দিয়েছি। পঁচাত্তরের পরে তাদের যে সম্মান হারিয়ে গিয়েছিল, তা আবার যেন ফিরে আসে আমরা তাঁর ব্যবস্থা নিয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, যে যেখানেই থাকুক, যে যে দলের থাকুক না কেন মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাই। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই তাঁরা সম্মান পাবে। আমরা সেই পদক্ষেপটা নিয়েছি।
অনুষ্ঠানে সশস্ত্র বাহিনীসহ সকল প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণে সরকার ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, এইটকু দাবি করতে পারি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, যেকোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সমানতালে পা মিলিয়ে চলতে পারে। সেই সক্ষমতা বাংলাদেশ অর্জন করেছে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা যে অর্জন করেছি সেটা ধরে রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সেটা মাথায় রাখতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমার একটাই লক্ষ্য দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক যারা তাঁরা যদি শিক্ষা-দীক্ষা, প্রশিক্ষণে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন না হয়, তাহলে বাংলাদেশের মর্যাদাও কখনো উন্নত হবে না।
সরকারপ্রধান আরও বলেন, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের আমরা আত্মসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এই কর্মসূচিগুলো শহরকেন্দ্রিক না, একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত। তৃণমূলের মানুষ যাতে সুফল পায় সেই পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি।
স্বাধীনতার পরে দেশের উন্নয়নে জাতির পিতার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সরকারে আসার পর একটাই লক্ষ্য ছিলো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবো। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে যে গৌরব পেয়েছিলাম, সে গৌরব বাংলাদেশ হারিয়েছিল পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যা করে। সেই গৌরব ফিরিয়ে এনে জাতির পিতার আদর্শ বাস্তবায়ন করবো। আজকে আমরা সেই আদর্শকে ধরে রেখে উন্নয়নশীল দেশে নিয়ে আসতে পেরেছি।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, এক্ষেত্রে দেশের প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসারসহ প্রতিটি স্তরের মানুষ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছে। মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ফলে একদিকে দুর্যোগ ও দুর্বিপাক যেটাই আসুক না কেন, তা মোকাবেলা করার সক্ষমতা অর্জন করেছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, বঙ্গবন্ধু জানতেন সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভের পরেও পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। যদি না করে তাহলে আমাদের যুদ্ধ করতে হব। সেটা করতে হলে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ, অস্ত্র কোথা থেকে আসবে, শরণার্থীদের আশ্রয় কোথায় হবে। এসব পরিকল্পনা তিনি সুপরিকল্পিতভাবেই করে রেখেছিলেন। যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করতো, তাহলে হয়তো আমরা বিনা যুদ্ধেই স্বাধীনতা লাভ করতে পারতাম। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা সেটা চায়নি।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযুদ্ধটা ছিলো জনযুদ্ধ। এতে দেশের প্রতিটি মানুষের অবদান রয়েছে। মা-বোনেরাও প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। যেহেতু গেরিলা যুদ্ধ হয়েছিল। তখন তাঁরা যখন বিভিন্ন অপারেশনে আসতেন। তাঁদের আশ্রয় দেওয়া, অস্ত্র রাখাসহ সবরকমের সহযোগিতাও করেছে দেশের অভ্যন্তরে। ২১ নভেম্বর স্বশস্ত্র বাহিনী ও আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিত আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়। ৩ ডিসেম্বর যুক্ত হয় ভারতীয় মিত্র বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সহযোগিতা ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করা হয়েছে দাবি করে শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করার পরে সেই ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছিলো। সবথেকে দুঃখের বিষয়টা হলো দেশের মানুষ সবকিছু ছেড়ে দিয়ে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাঁরা যে অবদান রেখেছিল। পঁচাত্তর পরবর্তী দেশে এমন একটা সময় এসেছিল যে, মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পরিচয় দিতেই ভয় পেতো। মনগড়া ইতিহাস চাপিয়ে দেওয়া চেষ্টা করা হয়েছিল। নিজেদের বিজয় গাঁথা ইতিহাস পৃথিবীর কোন দেশেই করা হয় না। সেই ধরণের জঘন্য কাজ এখানে হয়েছিল।
একটি আদর্শের জন্য আমার বাবা, মা, ভাই ও দেশের লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা জীবন দিয়েছে। তাদের এই রক্ত কখনো বৃথা যেতে পারে না। আমরা ব্যর্থ হতে দেবো না। তাই ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসা বলে জানান শেখ হাসিনা।
দেশের উন্নয়নের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সরকার কাজ করছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, জাতির পিতা তাঁর সমস্ত জীবনটা উৎসর্গ করেছিলেন। আমরা সন্তান হিসেবে বাবাকে কতটুকু পেয়েছি? একটানা দুটি বছরও তিনি আমাদের সঙ্গে থাকতে পারেননি। বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে জেল গেইটে। একই সঙ্গে আমাদের আওয়ামী লীগের অগণিত কর্মীরাও তাদের জীবনকে উৎসর্গ করেছে। এই দেশের মানুষ নিজেদের সমস্ত কিছু ঢেলে দিয়ে সমর্থন জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে। কাজেই সকল মানুষের প্রচেষ্টায় অর্জিত স্বাধীনতা কখনোই ব্যর্থ হতে পারে না।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, বাংলাদেশ উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ হিসাবে গড়ে উঠবে। বিশ্বে যে মর্যাদায় নিয়ে এসেছি। তা ধরে রেখে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। সশস্ত্র বাহিনী দিবসে আমি এইটুকুই চাই, আমাদের দেশের এই অগ্রযাত্রা কোনভাবে যাতে ব্যাহত না হয়। বাংলাদেশ যেন সারাবিশ্বে মর্যাদা নিয়ে চলতে পারে। প্রতিটি বাঙালি পৃথিবীর যেখানেই যাবে গর্ব করে বলতে পারবে, আমরা বিজয়ী, উন্নত জাতি। আমরা নিজেদের দেশকে গড়ে তুলেছি। সেইটুকুই আমাদের আকাঙক্ষা ও কামনা।
এর আগে সকালে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অণির্বার্ণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিন বাহিনীর প্রধান উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। পরে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজ্জাম্মেল হক কর্মকর্তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।