জলবায়ু সম্মেলন : সফল হয়েছে, হয়নি

কামরুল ইসলাম চৌধুরী

কপ২৬ সম্মেলন
কপ২৬ সম্মেলন। ছবি : ইন্টারনেট

সদ্য সমাপ্ত গ্লাসগো জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন কপ২৬ সফল হয়েছে, সফল হয়নি। সফল বলতে হয়, আয়োজক দেশ যুক্তরাজ্য বিশ্বজুড়ে জলবায়ু জরুরি অবস্থা সত্ত্বেও কোভিডের কারণে টানা দুবছর বিরতির পর জাতিসংঘ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন করতে পেরেছে। শীর্ষ সম্মেলন বসে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো নগরীতে ৩১ অক্টোবর থেকে। লম্বা অস্বাভাবিক ছেদ শেষে ফের শুরু হয় লাগাতার জলবায়ু আলোচনা। চলে ১৩ নভেম্বর মধ্যরাত অবধি এ শলা-পরামর্শ, দরকষাকষি ক্লাইড নদী তীরে গ্লাসগো প্রদর্শনী কেন্দ্রে।

করোনা মহামারির এ আকালে সূর্যোদয়ের দেশ জাপান থেকে সূর্যাস্তের মহাদেশ উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া থেকে আয়ারল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডসহ ১৯৭ দেশের হাজার হাজার সরকারি ডেলিগেট সশরীরে উপস্থিত হয়ে দিন-রাত ভর জলবায়ু আলোচনা করেন। সবাইকে দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিয়ে করোনা পিসিআর টেস্ট করে স্কটল্যান্ড যেতে হয়েছে। প্রতিদিন সম্মেলন কেন্দ্রে ঢোকার আগে করোনা টেস্ট করতে হয়েছে।

universel cardiac hospital

যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু উপদূত আমার সুদীর্ঘকালের বন্ধু জনাথন পিয়ার্সিং সম্মেলন কেন্দ্রে লাগাতার নেগোসিয়েশনে তার ক্লান্ত শরীর নিয়ে সহাস্যে জানালো, ‘কামরুল, আমরা জলবায়ু নেগোসিয়েশনে ফিরে এসেছি। যুক্তরাষ্ট্র জীবাশ্ম জ্বালানিকে জাদুঘরে পাঠাতে প্রস্তুত।’ তারপরই তার সহজাত কৌতুক, ‘তোমার বন্ধুরা তৈরি তো?’

১৪ দিন ধরে জাতিসংঘ জলবায়ু সনদের অধীনে জলবায়ু কপ২৬ সভাপতি অলোক শর্মার সভাপতিত্বে দফায় দফায় বসে পরামর্শ বৈঠক। চলে অষ্টপ্রহর দেন-দরবার। জনাথনের ঠাট্টার প্রতিধ্বনিও দেখতে সময় লাগেনি, কয়লা-ময়লার পক্ষে গুটিকয় রথী-মহারথীকেও দেখলাম ১৩ নভেম্বর দুপুরে শোরগোল তুলতে! ভারত-চীনের মন্ত্রী কয়লা পেজ আউটের বিরোধিতা করে সমাপনী অধিবেশন দীর্ঘায়িত করল। দুদেশ বাদবাকি বিশ্বের মতের তোয়াক্কা না করে পেজ আউট এ জোরালো শব্দবন্ধের পরিবর্তে হালকা পেজ ডাউন প্রস্তাব করে বসল শেষ মুহূর্তে। যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু দূত জন কেরি নিজ আসন থেকে ছুটে এলেন ৭৭-জাতিগোষ্ঠীর চেয়ার ঘিনির রাষ্ট্রদূত আহমদ টরের আসনের পেছনে। টরে ডাকলেন আমাকে। আমাদের ঘিরে শুরু হলো হারডেল! আমরা সময় চাইলাম।

অলোক শর্মা সমাপনী অধিবেশন মুলতবি করলেন। ৭৭-জাতির মন্ত্রীরা বসলেন জি৭৭ চেয়ারের সভাকক্ষে। পরিবেশ জলবায়ু সচিব মো. মোস্তফা কামালের বার্তা নিয়ে আমিও যোগ দিলাম বৈঠকে। জন কেরি, জনাথন, ৭৭-জাতি চেয়ার টরে, আফ্রিকার মন্ত্রীবর্গ, এলডিসি, দ্বীপরাষ্ট্র, ইউরোপ সবাই একমত হলো সম্মেলন সভাপতি অলোক শর্মার প্রস্তাবিত গ্লাসগো ক্লাইমেট প্যাক্ট-এ কোনো পরিবর্তন এ শেষ মুহূর্তে আনা যাবে না।

সমাপনী অধিবেশন ফের বসল। ভারতীয় মন্ত্রী অনড়। কয়লা পেজ আউট ভারত মানে না। বিকল্প পেজ ডাউন শব্দবন্ধ। সুইজারল্যান্ডের মন্ত্রী, দ্বীপ দেশগুলোর মন্ত্রীবর্গ, এলডিসি, ইউ মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে আবেগময় ভাষণ দিলেন কয়লার ময়লা দূর করতে। কিন্তু ভারত-চীন অটল। অবশেষে সমঝোতার স্বার্থে শেষ বিকালে গোটা দুনিয়ার মন্ত্রী পর্যায়ের ডেলিগেটরা তা মেনে নিলেন। কয়লার ময়লা আরও কিছুকাল আকাশে-বাতাসে বিষ ছড়াতে রয়ে গেল। তবে, আশার কথা বেশিকালের জন্য নয়। জলবায়ু জরুরি অবস্থা বিবেচনায় হতদরিদ্র আর উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু আলোচনায় এ ছাড়ে না পারতে রাজি হয়। সে কারণে বলি সম্মেলন সফল হয়নি।

আশার কথা, জো বাইডেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য সম্পাদিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে চার বছর পর ফিরে এসেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে বলে মানতেন না, যেমন করোনা নিয়েও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন। তাই ট্রাম্প বারাক ওবামার আমলের এ বৈশ্বিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন। জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য গঠিত সবুজ জলবায়ু তহবিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুত দুশ কোটি ডলার আর ছাড় করেননি। অথচ, জলবায়ু পরিবর্তনের ঐতিহাসিক দায় সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রের। এরপর ইইউ, যুক্তরাজ্য, জাপান, রাশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ শিল্পোন্নত দেশগুলো। তবে এখন যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে চীন সবচেয়ে বেশি কার্বণ নিঃসরণ করছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনৈতিক অর্থনীতিও বদলে যাচ্ছে। সে পালাবদলের পরিপ্রেক্ষিতেই ফের শুরু হলো জলবায়ু আলোচনা। আরও মনে রাখতে হবে, বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে মূলত মানুষের অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডে। দুনিয়াজুডে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণের সমন্বয়ে বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে। এর একটি উপাদান ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য সামগ্রিকভাবে বিনষ্ট হয়। ফলে উৎপাদন, ভোগ আর অনুজীবের চক্রাকার খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে যায়।

বুঝতে হবে কেন জল ও বায়ুচক্রে পরিবর্তন হয়? শিল্পবিপ্লবের পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির অপরিনামদর্শী ব্যবহারের ফলে জলবায়ুর এ পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের সেই ভারসাম্যই সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়ে। তাই বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। বরফ গলছে মেরু অঞ্চলে। দ্রুত হারে বাড়ছে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা। সাগরের নোনাজল ঢুকছে উপকূলে। বদলে যাচ্ছে বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল। বন্যহাতির চলাচলের করিডোর, ডলপিনের আবাস। আর হারিয়ে যাচ্ছে এসব প্রাণীর হরেকরকমের প্রজাতি। হারিয়ে গেছে নানা ঔষধি বৃক্ষ, লতাগুল্ম। হানা দিচ্ছে নানা ধরনের ভাইরাস। করোনাক্রান্তিতে জনজীবন লন্ডভন্ড।

আবার এখন জোরালো হচ্ছে, ফিরিয়ে দাও হে মোর অরণ্য। জীবন বাঁচাতে প্রাণ-প্রকৃতিকে, মা ধরিত্রীকে রক্ষা করতে তাই এবার ২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস এ করোনা মহামারির আকালে বিশেষভাবে পালিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে শুধু ফিরেই আসেনি, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্বের চল্লিশ রাষ্ট্র এ সরকারপ্রধানকে নিয়ে লিডার্স ক্লাইমেট সামিট করেছেন। জীবাশ্ম জ্বালানি কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার, পরিবেশের প্রতিটি উপাদান সংরক্ষিত হলেই বাস্তুসংস্থান চক্র বজায় থাকবে।

প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার ব্রত নিয়ে ১৯৭০ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ধরিত্রী দিবস পালিত হয়ে আসছে। এবারের দিবসটির আলাদা বিশেষত্ব ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে দুদিনের জলবায়ুবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন। নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘ আয়োজিত জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সম্মেলনের (কপ২৬) আগে এ সভাটি কিছুটা হলেও সফল বলা যায়। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী বড় শিল্পোন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর নেতৃবৃন্দকে অনেকদিন পর ভার্চুয়ালি একই মঞ্চে আনা সম্ভব হয়েছে। যদিও রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কিছু দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি কমানোর অঙ্গীকার করেনি। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়নের ব্যাপারেও বড় প্রতিশ্রুতি মেলেনি।

জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম সভাপতি হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ দ্রুত কমানোর তাগিদ দিয়েছেন। ২০২০ সাল থেকে ফি বছর ১০ হাজার কোটি ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি পূরণের দাবির পাশাপাশি জলবায়ু অর্থায়ন বাড়ানোর কথা বলেছেন। কপ২৬ শীর্ষ সম্মেলনে তিনি সে দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনৈতিক অর্থনীতি বেশ কুটিল, পরিবর্তনশীল। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর নেতা হিসাবে বাংলাদেশ বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছে। সাবের হোসেন চৌধুরী জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন অর্থায়ন দ্বিগুণ করার জোর দাবি জানান এলডিসি মন্ত্রীদের পক্ষে সম্মেলনে শেষ অধিবেশনগুলোতে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন একটি অসম প্রক্রিয়া। যেমন ধরুন, জলবায়ু পরিবর্তনের বড় কারণ বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান মাত্র শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ।

কিন্তু বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। বিশ্বের সবকটি দেশের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিজ্ঞানীদের জোট বা প্যানেল আইপিসিসির পঞ্চম প্রতিবেদন বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষ ঝুঁকিতে পড়বে। ২০১২ সালে প্রকাশিত ক্লাইমেট ভালনারেবিলিটি মনিটরের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বছর অতিরিক্ত ছয় লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকিতে পড়বে।

তাই, ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে নিজের অধিকার আদায় করে নিতে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প ছিল না। আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তনে ঐতিহাসিকভাবে উন্নত দেশগুলো দায়ী। আর উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তাই জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সনদ অনুযায়ী, জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলা সার্বজনীন উদ্দেশ্য ও অগ্রাধিকার হলেও দেশভেদে দায়িত্ব ভিন্ন। জলবায়ু সনদ মোতাবেক উন্নত দেশগুলোকে বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি দেশের বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের উন্নত, টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও বৈষম্যহীন জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। উন্নত দেশগুলোকে এ সত্য কার্যকরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণসহ টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে।

জলবায়ু সনদ যখন ১৯৯২ সালে তৈরি হয়, তখন এ মূলনীতিগুলো ছিল। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরে অনুষ্ঠিত রিও সম্মেলনের ঘোষণায়ও সেগুলো রয়েছে। পরবর্তীকালে তা দুর্বল হতে হতে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। শিল্পোন্নত দেশগুলো আগেই বিশ্বের বায়ুমণ্ডলে বিপুল পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ করেছে। এ শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে দিতে না চাইলে কার্বন নিঃসরণ দ্রুত কমাতে হবে। শিল্পোন্নত দেশ কী পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমাবে, তার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে দেশগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো কার্বন নিঃসরণ নিয়ে কাজ করছে। তাই সামগ্রিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা রয়ে গেছে।

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ ছাড়াও হরেকরকমের পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে আশাব্যঞ্জক কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা দেশের পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করছে। বন্যহাতির চলাচলের করিডোর পর্যন্ত বিনষ্ট হয়েছে। ২০১৭ সালে নতুন করে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা আসার পর দুই হাজার হেক্টর বন ধ্বংস হয়েছে। রোহিঙ্গা শিবির এলাকার মাটি, পানি, বন ও জীববৈচিত্র্য বড় ধরনের হুমকিতে পড়েছে। বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য ভেঙে পড়ায় আর্থ-সামাজিক ক্ষতি আরও বাড়ছে। রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে বিশ্বনেতৃত্বকে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে উত্তরণ ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাংলাদেশকে জোরালোভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করতে হবে। বারো-তের বছর আগে ২০০৮-২০০৯ সালে প্রণীত বাংলাদেশ জলবায়ু কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা হালনাগাদ করতে হবে জরুরিভাবে। বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত ওই দলিলের একজন প্রণেতা হিসাবে এ আমার দাবি। জাতীয় অভিযোজন কর্মপরিকল্পনা (নাপ) তৈরির কাজও কয়েক বছর ধরে ঝুলে আছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু সচিব মো. মোস্তফা কামাল এর কাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়েছেন। কপ২৬ সম্মেলনের আগে নাপও চূড়ান্ত করা দরকার ছিল। এখন অবশ্যই মিসরের শারম আল শেখ কপ২৮ সম্মেলনের বেশ আগে নাপ চূডান্ত করতে হবে জন অংশগ্রহণের ভিত্তিতে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রতিরোধে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ২০৩০ সাল নাগাদ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যে পরিমাণে কমাতে হবে, বর্তমানে বিশ্ব তার চেয়ে ১২০ শতাংশ বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পথে রয়েছে। গ্লাসগো সম্মেলনে রাশ জানার চেষ্টা করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংক জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পে বিনিয়োগ করেই চলেছে। জার্মানভিত্তিক পরিবেশবাদী গ্রুপ আর্জওয়ার্ল্ডের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি সইয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত জীবাশ্ম জ্বালানিসংশ্লিষ্ট প্রকল্পে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে বিশ্বব্যাংক। অথচ বিশ্বব্যাংকই বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব কমাতে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ২০৩০ সাল নাগাদ ১০ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যের কাতারে চলে যাবে। এটি স্পষ্টত পরস্পরবিরোধী নীতি।

জাতিসংঘ জলবায়ু সনদের অধীনে ১৯৯৭ সালে করা বহুরাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিক চুক্তি কিয়োটো প্রটোকলে কার্বন নিঃসরণ কমাতে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ কমানোর অঙ্গীকার করেছিল। রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ও কার্বন নিঃসরণের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে তৈরি করা ওই চুক্তির শর্ত সব দেশ পালন করেনি। পরবর্তীকালে ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ‘ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনের (এনডিসি) নামে সে বাধ্যবাধকতার শর্তটি উঠিয়ে দেওয়া হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে ঐচ্ছিকভাবে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন মাত্রা ঠিক করা হয়েছে। যার অর্থ হলো, রাষ্ট্রগুলো জাতীয়ভাবে নির্গমন কমানোর মাত্রা ঠিক করবে এবং তা পূরণের জন্য কাজ করবে। বাধ্যবাধকতার শর্ত উঠিয়ে নেওয়ার পরও দেশগুলো পর্যাপ্ত কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি গেল ছয় বছরে।

২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত চুক্তির ১৯৭টি দেশের মধ্যে মাত্র ৯৫টি দেশ নতুন এনডিসি দাখিল করেছে। এরা বেশিরভাগই উন্নয়নশীল দেশ। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মতো সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ এনডিসি দাখিল করলেও লক্ষ্যে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। আবার জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো অধিকাংশ দেশ নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য বৃদ্ধি করেনি। চীন বলছে, ২০৬০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনবে। ভারত ২০৭০ সালে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিঃসরণ ৫৫ শতাংশ ও যুক্তরাজ্য ৬৮ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে; যা পর্যাপ্ত নয়।

২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৪৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন রূপরেখা সনদের (ইউএনএফসিসিসি) এক সমীক্ষা বলছে, যেসব দেশ ইতোমধ্যে এনডিসি দাখিল করেছে, তাদের অঙ্গীকার অর্জিত হওয়ার পরও ২০১০ সালের তুলনায় ২০৩০ সাল নাগাদ বৈশ্বিকভাবে মাত্র ১৭ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানো সম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে বড় রকমের ধাক্কা না দিলে ২০৫০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে না। সে বড় ধাক্কা কতটা দেওয়া হবে, কীভাবে দেওয়া হবে, সে আলোচনাই এবার শুরু হলো। চলবে কপ২৭ মিসরে ২০২২ নভেম্বরে, কপ২৮ ইউএই ২০২৩।

আমাদের দরকষাকষির ফলে কোপেনহেগেন আর কানকুন সম্মেলনে ধনী দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে দরিদ্রদের জন্য বছরে ১০ হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতিও অধরাই থেকে যাচ্ছে। বাস্তবে, বিশ্বের কয়েকটি দরিদ্রতম দেশের জনগণ প্রতি বছর জলবায়ু সংকটের প্রভাব মোকাবিলায় মাথাপিছু মাত্র ১ ডলারের মতো সহায়তা পাচ্ছে! যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে কপ২৬-এ নতুন তহবিল ঘোষণা করা হয়নি। নতুন বোতলে পুরোনো দাওয়াই পরিবেশিত হলো। উপরন্তু আগের অঙ্গীকার পূরণ করা হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় অবশ্য কিছুটা কেটেছে। জো বাইডেন, জন কেরি, জনাথন, ট্রিগ তুলি, বরিস জনসন, অলোক শর্মা, ইউ, সুইজারল্যান্ড আমাদের কথা দিয়েছেন, তারা কথা রাখবেন। উন্নয়নশীল দেশগুলো একাট্টা ছিল বলে জলবায়ুতাড়িত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় কিছুটা আশাব্যঞ্জক ফল কপ২৬ সম্মেলনে পাওয়া গেছে।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের শিকার দেশগুলোর বিপন্নতার সুযোগ নিচ্ছে বিশ্বব্যাংকের মতো বহুজাতিক সংস্থা। বেসরকারি সংস্থা অক্সফাম বলছে, জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রভাব মোকাবিলায় সাহায্যের বদলে দরিদ্র দেশগুলোকে কোটি কোটি ডলার ঋণ দেওয়া হচ্ছে।

আরও সত্যি, কপ২৬ সম্মেলনের আগে আয়োজনকারী দেশ যুক্তরাজ্য জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, যা বৈশ্বিকভাবে ভুল বার্তা দেয়। সিদ্ধান্তগুলো প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, বৈদেশিক সহায়তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ করা, মহাসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নতুন করে অনুমতি দেওয়া, বিদ্যুৎচালিত গাড়িতে প্রণোদনা কমানো, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সংশয়বাদী একজনকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) প্রধান করায় সমর্থন, গ্রিন হোম গ্রান্ট নামে যুক্তরাজ্যের একমাত্র সবুজ পুনরুদ্ধার কর্মসূচি থেকে সরে আসা, নতুন বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ইত্যাদি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত প্যারিস চুক্তির অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন এবং লর্ড নিকোলাস স্টার্ন ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে তার জলবায়ু অর্থায়ন কমানোর সিদ্ধান্তে পরিবর্তন করে বাড়তি অর্থায়নের অঙ্গীকারের ডাক দিয়েছেন। তাই যুক্তরাজ্যেও নীতি পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যায়। তার ইতিবাচক প্রভাব জলবায়ু আলোচনায় কিছুটা পড়ে।

বর্তমানে বিশ্বে মোট শক্তি ব্যবহারের ৮১ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানি। উদ্বেগজনকভাবে কয়েক দশক ধরে অব্যাহতভাবে মোট জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে। একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক চুক্তি এ বিপর্যয় অনেকাংশে এড়াতে পারে। দরিদ্র দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসতে পর্যাপ্ত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যের জলবায়ুমন্ত্রী কপ২৬ সভাপতি অলোক শর্মার নেতৃত্বে ধনী সাত জাতি মন্ত্রী সম্মেলনে ২০২১ সালের শেষ থেকে আর কোনো জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ না করার ঘোষণা করা হয়েছে, যা ইতিবাচক। অলোক বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম আর ইন্দোনেশিয়া সফরে এসে আমাদের কথা দিয়েছিলেন; পুরোটা হয়তো রাখতে পারেননি। সমাপনী অধিবেশনে তার অসহায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা তার সাক্ষ্য দেয়।

প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ আহরণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে ধ্বংস ত্বরান্বিত না করে টেকসই পথে চলা শুরু করতে হবে আর কাল বিলম্ব না করে। উৎপাদন ব্যবস্থা টেকসই, সবুজ ও পরিবেশবান্ধব করা ছাড়া উপায় নেই। প্রাণ-প্রকৃতিবিধ্বংসী ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে মানুষ ও প্রকৃতির ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কই এখন বিশ্ববাসীর কাম্য। পৃথিবীর সর্বজনের এই আকাঙ্ক্ষার জন্য বৈশ্বিক সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের বিকল্প নেই।

প্রত্যাশা করছি, বছরে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার জীবাশ্ম জ্বালানির পেছনে ভুর্তকি না দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের অঙ্গীকার আসবে কপ২৭ সম্মেলন থেকে। এখন নিতে হবে কপ২৭-এর পূর্ণ প্রস্তুতি। তাহলেই নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগসহ জলবায়ু প্রশমন ও অভিযোজনে অর্থায়নের জোর প্রতিশ্রুতি ও পথনকশা মিলবে। জলবায়ুতাড়িত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় মিলবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন, কারিগরি ও প্রযুক্তি সহযোগিতা। কার্বণ নিঃসরণ দ্রুত কমানোর পাশাপাশি অভিযোজন করতে হবে। ধ্রুপদি গবেষণা করতে হবে। জলবায়ু অর্থায়ন বাড়াতে হবে। সবুজ উন্নয়নের পথে হাঁটতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য যেতে হবে বহুদূর। পাড়ি দিতে হবে দুর্গম পথ।

কামরুল ইসলাম চৌধুরী : জলবায়ু সম্মেলনে ১৩৪ উন্নয়নশীল দেশের জোট ৭৭-জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম লিড নেগোশিয়েটর, কিয়োটো প্রটোকল যৌথ বাস্তবায়ন কমিটির সাবেক চেয়ার, জলবায়ু অভিযোজন কমিটির সাবেক সদস্য

শেয়ার করুন