গণতন্ত্রের সমস্যা কেবল বাংলাদেশের নয়, এটা এখন সমগ্র বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য। যতই দিন যাচ্ছে, পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অথবা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে, যেগুলোর শাসকরা তাদের দেশকে গণতান্ত্রিক বলে উপস্থাপন করতে চান, কিন্তু বাস্তবতা হলো, গণতন্ত্রের লেবাসে এসব দেশে চলছে কর্তৃত্ববাদ।
কিছু দেশ আছে যেগুলোর শাসকগোষ্ঠী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে বাতিল করতে লজ্জাবোধ করেনি। দেশের তাবৎ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে জনগণকে তাদের খেয়ালের দাসে পরিণত করতে কুণ্ঠিত হয় না। বিশ্বায়নের বর্তমান পর্যায়ে পৃথিবীর দেশে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নানা ধারনের থিংক ট্যাংক। এরা মানবজাতির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে গবেষণা করে।
এ রকম অনেক সংস্থা আছে, যাদের গবেষণার ফলাফল বিদ্যমান অবাঞ্ছিত শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়। একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে পৃথিবীর অনেক দেশেই গণতন্ত্র ক্ষয়িষ্ণু হয়ে উঠেছে। গত ২২ নভেম্বর ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিসট্যান্স (IDEA) একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এ রিপোর্টের শিরোনাম হলো ‘গ্লোবাল স্টেট অফ ডেমোক্রেসি ২০২১’। এ রিপোর্ট বা প্রতিবেদন বিশ্ব জনমতকে সচেতন করার জন্য বলেছে, পৃথিবীর বিশাল সংখ্যক দেশ কর্তৃত্ববাদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে যাচ্ছে। ইতঃপূর্বে আর কখনো এত বিরাট সংখ্যক প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে পড়তে দেখা যায়নি।
সুইডেনের স্টকহোমভিত্তিক আন্তঃসরকার সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি, সমালোচকদের বাক্ রহিত করার জন্য করোনা মহামারিকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এর জন্য অন্যদের গণতন্ত্রবিরোধী আচরণকে নকল করার প্রবণতা এবং সামাজিক বিভক্তিকরণে ব্যবহৃত বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারই দায়ী।
গত কয়েক বছর ধরে ইউরোপের অনেক দেশে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির প্রচার-প্রচারণা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এসব দেশের ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির আক্রমণের ফলে আত্মরক্ষামূলক রাজনীতি চর্চা করতে বাধ্য হচ্ছে। এদিকে জনতুষ্টিবাদী রাজনৈতিক দলগুলো অল্প সময়ের মধ্যে যে শক্তি সঞ্চয় করেছে, তা রীতিমতো ভয়ংকর। অন্য দেশ থেকে আগত অভিবাসীরা স্থানীয়দের বেকারত্বের জন্য দায়ী এমন বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালানই জনতুষ্টিবাদীদের রাজনীতি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্ণবাদী ঘৃণার রাজনীতি।
অপপ্রচার এবং জাতিগত বিদ্বেষ চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়লে ভবিষ্যতে হিটলার-মুসোলিনির পুনরুত্থানের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। গণতন্ত্রের জন্য মডেল রাষ্ট্র হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রথমবারের মতো নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালে দেশটির গণতন্ত্রে ‘দৃশ্যমান অবনতি’ সূচিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘এই বছর আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথমবারের মতো ব্যাক স্নাইডিং হিসাবে দেখিয়েছি। তবে আমাদের তথ্য থেকে বোঝা যায় ব্যাক স্নাইডিং পর্বটি ২০১৯ সালের দিকে শুরু হয়েছিল।’
প্রতিবেদনের সহলেখক আলেকজান্ডার হার্ডসন বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ চর্চা হয়। ২০২০ সালে নিরপেক্ষ প্রশাসনের সূচকগুলোতে দেশটি উন্নতি করেছে। তবে নাগরিকদের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়াসহ আরও কিছু বিষয়ে গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়গুলোতে ঘাটতি আছে।’
অতীতের তুলনায় অনেক বেশি দেশ গণতন্ত্রের ক্ষয়ীভবনের শিকার হচ্ছে। এ প্রতিদেনটির আকর্ষণীয় দিক হলো, ১৯৭৫ সাল থেকে শুরু করে সর্বশেষ অবস্থার ওপর প্রতিবেদনটি তৈরি হওয়া। স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলো গর্ব করে বলত-তাদের আদর্শ অর্থাৎ ‘গণতন্ত্র’ কমিউনিজমের চেয়ে শ্রেয়।
এ দেশগুলো নিজেদের ‘ফ্রি-ওয়ার্ল্ডে’র অন্তর্ভুক্ত দেশ বলে দাবি করত। অর্থাৎ সেসব দেশে বাক্ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা রয়েছে এবং জনগণ নিজ পছন্দমতো সরকার গঠন করতে পারে। অন্যদিকে কমিউনিস্ট শিবিরে এসব স্বাধীনতা নেই। তখন মার্কিন প্রচারমাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আয়রন কার্টেইন এবং চীনকে ব্যাম্বো কার্টেইন বলা হতো।
এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে গণতন্ত্র আরও পরিশীলিত ও মার্জিত না হয়ে পিছু হটছে এমন অবস্থা দেখে বিচলিত হতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের এ দশার কারণে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশে গণতন্ত্র পশ্চাৎমুখী হবে তা সহজেই অনুমেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ব্যাক স্নাইডিং অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। এক সময় পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রকে সমান্তরাল রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো বিবেচনা করা হতো। ব্যারিংটন মুরের মতো পণ্ডিত ব্যক্তি তার সোস্যাল অরিজিন অফ ডিক্টেটরশিপ অ্যান্ড ডেমোক্রেসি গ্রন্থে লিখেছেন, নো বুর্জোয়া, নো ডেমোক্রেসি।
একটি রাষ্ট্রে বুর্জোয়া বিকাশের ফলে গণতন্ত্র সুসংহত হয়, ব্যারিংটন মুরের শক্তিশালী থিসিস অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। বুর্জোয়া বিকাশ কোন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নিশ্চিত হয়? এ প্রশ্নের উত্তর ছিল পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই বুর্জোয়া বিকাশের একমাত্র পূর্বশর্ত। ব্যারিংটন মুরের বইটি বেরিয়েছিল কয়েক দশক আগে।
এ কয়েক দশকের মধ্যে বুর্জোয়া শ্রেণিশাসিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেন গণতন্ত্র পিছু হটছে? তাহলে কি বলতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখন আর বুর্জোয়া বিকাশের জন্য সহায়ক নয়? এ পরিস্থিতি একজন খাঁটি গণতন্ত্রীকে ভাবিয়ে তুলবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির চর্চা হচ্ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অনেক বক্তব্যে জনতুষ্টিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। এর ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন জনমতের ওপর নিজের একটা অবস্থান নিশ্চিত করতে পেরেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটিতে গণতন্ত্র পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করলে অনুন্নত দরিদ্র দশগুলোতে গণতন্ত্র কী চেহারা ধারণ করবে তা সহজেই অনুমেয়।
আলোচ্য প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে ‘গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসারণ’-এর মধ্য দিয়ে যাওয়া দেশের সংখ্যা এত বেশি কখনো ছিল না। সরকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রগুলোতে পশ্চাদপসারণমূলক বাঁকের কথা উল্লেখ করে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়। উদাহরণ হিসাবে আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক অবস্থা এবং মিয়ানমারের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়।
এসব দেশে ইতোমধ্যেই গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছে। আফ্রিকার মালিতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। নির্বাচনের ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কেও বড় ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রসঙ্গে ব্রাজিলের দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রেও নির্বাচনের ফলাফলকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতে সরকারি নীতির সমালোচকদের আইন-আদালতের মুখোমুখি করা হচ্ছে।
এসব দৃষ্টান্ত থেকে বলতে হয়, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিলেও পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোয় গণতান্ত্রিক বিধিবিধান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে এর কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে কিনা সে ব্যাপারেও প্রশ্ন উঠতে পারে। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, স্লোভেনিয়া ও সার্বিয়ার গণতন্ত্রের সবচেয়ে বেশি পতন ঘটেছে। এ ছাড়া ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে তুরস্ক তাদের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ধস প্রত্যক্ষ করেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর ৭০ শতাংশ মানুষ এমন দেশে বাস করছে যেখানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নেই, অথবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পিছু হটছে। এএফপি’র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বের প্রতি ৩ জন মানুষের মধ্যে ১ জন কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছে এবং প্রতি দুজনের মধ্যে একজন এমন দেশে বাস করছে যেখানে গণতন্ত্র পিছু পথ ধরেছে।
পৃথিবীতে গণতন্ত্রের এ চেহারা যে কোনো বিবেকবান মানুষকে উদ্বিগ্ন করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে গণতন্ত্র টেকসই রূপ গ্রহণ করতে পারে যে পরিস্থিতিতে, তার জন্য নির্ভরযোগ্য কোনো তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নেই। যেগুলো আছে সেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী শিবিরের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ হয়েছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এ দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি বদলে গেল। শুরু হলো ভিন্ন ধরনের আরেক দ্বন্দ্ব।
এ দ্বন্দ্ব হলো পাশ্চাত্য বনাম উগ্র ইসলামপন্থিদের মধ্যে। ‘ইসলামো ফোবিয়া’ নামে আমরা নতুন কথা শুনতে পেলাম। ইসলামো ফোবিয়ার ভর কেন্দ্র আফগানিস্তানে বিশ বছর ধরে চলা যুদ্ধ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হাত গুটিয়ে নিয়েছে। এর পর ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কোনদিকে গড়াবে? মনে হচ্ছে এ দ্বন্দ্ব হবে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। এর নানা আলামত এখনই দেখা যাচ্ছে।
গণতন্ত্রের অনুশীলন পশ্চাৎমুখী হলে বুর্জোয়া গণতন্ত্রহীন চীনের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা নৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গণতন্ত্রের ওপর বিশ্ব সম্মেলন ডেকেছেন। এ সম্মেলনে পৃথিবীর ১০০টি দেশ আমন্ত্রিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ করা হয়নি। বাংলাদেশের নাগরিকরা এ ব্যাপারে কী ভাবছেন তা জানা এবং বোঝা অতি জরুরি।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ