পৃথিবীর আলো দেখার আগেই বাবার চিরবিধায়। জন্মের পর শুরু হয় তার এক অনিশ্চিত জীবন। সেই অনিশ্চয়তাকে উপেক্ষা করেই মায়ের হাত ধরে এগিয়ে চলে সে। চলার পথে বাধা এসেছে, হোঁচটও খেতে হয়েছে। তখন মানুষই তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে। তাতে পেয়েছেন ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি। সীমাহীন ধৈর্য আর অদম্য ইচ্ছার জোরেই এখন পৌঁছেছে স্বপ্নের ধারপ্রান্তে। বলছি শোভা রানীর কথা।
ছোটবেলা থেকেই মেধাবী শোভা এবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি পরীক্ষায় পেয়েছেন সাফল্যের দেখা। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ফলাফলে মেধাতালিকায় ৭২২তম হয়ে পেয়েছেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির সুযোগ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা শোভা রাণী এর আগে তিন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধাতালিকায় ৮৮৬তম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সি ইউনিট তৃতীয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক ইউনিট ১০৯তম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ইউনিট ১৯তম, এইচ ইউনিট ১৯তম এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) ভর্তি পরীক্ষায় ৩৬৫তম হন । তবে স্বপ্ন বাস্তবায়নে বুয়েটে পড়তে চান তিনি।
শোভা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের মধ্যপাড়া এলাকার প্রতিমা রানী দাসের একমাত্র সন্তান। শোভার জন্মের পাঁচ-ছয় মাস আগেই নিখোঁজ হয়ে বাবা বুলু চন্দ্র লোদ মারা যান। বাবার বাড়ি ছিল জেলার কসবা উপজেলার কুটি চৌমুহনীর মকিমপুর গ্রামে। শোভা যখন গর্ভে, তখন থেকেই মা প্রতিমার সংগ্রাম শুরু। স্বজনদের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে মা-মেয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। শেষ পর্যন্ত মেয়ের চিন্তা করেই দ্বিতীয় বিয়ে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসেন প্রতিমা। কিন্তু সেখানেও ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। সহ্য করতে হয় স্বামীর নিয়মিত নির্যাতন। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই জেএসসি ও এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পান শোভা।
তাঁকে পড়াতে গিয়ে মা দিনের পর দিন কাজ করেছেন। আচারের এক হাজার প্যাকেট বানালে ৩০ টাকা, এক কেজির চকলেট বানালে ১ টাকা করে পেতেন। শোভাও মাঝেমধ্যে এ কাজে সহায়তা করতেন। কিন্তু এসএসসি ফলাফল প্রকাশের দিনই শোভাকে ঘর থেকে বের করে দেন তার সৎবাবা।
এসএসসির পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার আগের দিন রাতে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া লেগে সৎবাবা শোভাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। রাতভর শোভা কিছুই পড়তে পারেননি। কিন্তু এই পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষায় শোভা পান ৯৮ নম্বর। এসএসসিতে গণিতে ৯৯, রসায়ন ও উচ্চতর গণিতে ৯৮ নম্বর করে পেয়েছেন শোভা। এসএসসিতে প্রতি বিষয়ে তাঁর গড় নম্বর ৯৮ দশমিক ৯১।
শোভা রানী বলেন, ‘মা নিরুপায় হয়ে আমার চিন্তা করেই তখন বিয়ে করেন। কিন্তু লোকটি মাদকাসক্ত ছিলেন। এমন কোনো নির্যাতন নেই, লোকটি করেননি। তবু আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ, তিনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন।’
পড়াশোনা করার সংগ্রাম নিয়ে শোভা বলেন, তাঁকে পড়াতে গিয়ে মা দিনের পর দিন কাজ করেছেন। আচারের এক হাজার প্যাকেট বানালে ৩০ টাকা, এক কেজির চকলেট বানালে ১ টাকা করে পেতেন। শোভাও মাঝেমধ্যে এ কাজে সহায়তা করতেন। সপ্তম শ্রেণিতে টিউশনি শুরু করেন। এতে যা আসত, তা দিয়েই পড়াশোনা ও মা-মেয়ে চলতেন।
শোভা বলেন, নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা বন্ধই করে দিতে চেয়েছিলেন। স্থানীয় অক্সফোর্ড কোচিং সেন্টারের শিক্ষকেরা সহায়তা করেন, অনুপ্রেরণা দেন। এসএসসি পর্যন্ত তাঁরা বিনা পয়সায় পড়িয়েছেন। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে উঠে কেন্দ্রবিন্দু একাডেমিক কেয়ার বিনা মূল্যে পড়িয়েছে। পাশাপাশি প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা দিয়েছে। এসবেই পড়াশোনা, মেসের ভাড়া, খাওয়া ও মায়ের চিকিৎসা করেছেন। অনেক অনিশ্চয়তা ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এসেছেন। অনেকবার ভেঙে পড়েছিলেন। তবু পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। হাল ছাড়েননি। ধৈর্য তাঁর মূল শক্তি ছিল।
এরপর শোভা ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বৃত্তি পান। সেই বৃত্তি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচিং ও হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা বিনা মূল্যে ছিল। পরে মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরীক্ষার ফরম পূরণ ও যাতায়াত খরচের বৃত্তি পান।
শোভা বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকসহ তাঁকে সহায়তায় এগিয়ে আসা সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পাচ্ছে। প্রকৌশলী হয়ে আরও শোভাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমার জীবনের লক্ষ্য, আমি মানুষ হতে চাই।’