বুধবার (১ ডিসেম্বর) রাত ৯টার কিছুক্ষণ পর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত এক সংস্থার কাছে একটি ফোন আসে। মালয়েশিয়ান নম্বর থেকে আসা ফোনের অপর পাশ থেকে বলা হয়, ‘মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের এমএইচ-১৯৬ ফ্লাইটে বোমা আছে।’ মুহূর্তেই এ তথ্য ছড়িয়ে পড়ল বিমানবন্দরের সর্বত্র।
বোমার তথ্য নিয়ে এমএইচ-১৯৬ এর ক্যাপ্টেনের সঙ্গে নিয়মিত কথা হচ্ছিল ঢাকার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) রুমের। ক্যাপ্টেন জানালেন তিনি জরুরি অবতরণ করতে চান। সঙ্গে সঙ্গে জরুরি অবতরণের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়।
বিমানবন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারা মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইটটিতে তিন ঘণ্টা ২০ মিনিট অর্থাৎ ২০০ মিনিটের রুদ্ধশ্বাস অভিযানের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে মত ও পথকে এসব তথ্য জানান।
রাত ৯টা ১৫ মিনিট
ঢাকার আকাশে দেখা যাচ্ছিল এমএইচ-১৯৬ ফ্লাইটটি। নিচে প্রস্তুত ছিল ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, র্যাব-পুলিশ, এয়ারপোর্ট এপিবিএন, ডগ স্কোয়াড, বিমান বাহিনীর বোমা ডিস্পোজাল স্কোয়াড, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স (এভসেক), বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও স্বাস্থ্য বিভাগ।
রাত ৯টা ৩৮ মিনিট
বিমানের চাকা রানওয়ে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই কাছে এগিয়ে যায় বাহিনীগুলোর সদস্যরা।
রাত ৯টা ৪৪ মিনিট
বিমানটি রানওয়েতে থামে। নিরাপত্তার কারণে কাউকে বোর্ডিং গেট বা এর আশপাশে আসতে দেওয়া হয়নি। বিমানটির চারপাশ ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
রাত ৯টা ৫০ মিনিট
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও নভোএয়ারের বাসগুলোকে রানওয়ের সামনে ডেকে পাঠায় কর্তৃপক্ষ। যাত্রীদের লাইন করে একে একে বিমান থেকে বের করে আনা হয়। তাদের শরীর স্ক্যানার দিয়ে তল্লাশি করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিল ডগ স্কোয়াড। মানবদেহের বোমা শনাক্তের যন্ত্রপাতি নিয়ে ভিডিও টিমও সেখানে উপস্থিত ছিল। পরে যাত্রীদের বাসে তুলে দেওয়া হয়।
রাত ৯টা ৫০ মিনিট
একদিকে যখন যাত্রীদের দেহ তল্লাশি হচ্ছে, তখন পাইলটের সঙ্গে কথা বলে বিমানের বাইরের অংশে বোমা শনাক্তে স্ক্যান শুরু হয়।
রাত ৯টা ৫৫ মিনিট
ডগ স্কোয়াডসহ বোমা ডিস্পোজাল ইউনিটের সদস্যরা কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করে বোমার সন্ধান শুরু করেন। তারা ককপিট, ক্যাফে, সিট, টয়লেটসহ সর্বত্র স্ক্যান করেন। প্রায় এক ঘণ্টা অনুসন্ধানের পর কোনো বোমা বা বিস্ফোরকের অস্তিত্ব না পেয়ে তারা নেমে আসেন।
রাত ১১টা ০০ মিনিট
১৩৫ যাত্রীকে নিবিড়ভাবে তল্লাশির পর টার্মিনাল ভবনে আনা হয়। অনেকে এ সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
রাত ১১টা ১৫ মিনিট
বিমানের পেছনের কম্পার্টমেন্ট থেকে একে একে লাগেজ বের করে আনা হয়। প্রতিটি লাগেজ আলাদাভাবে স্ক্যান করা হয়। ডগ স্কোয়াড দিয়েও চালানো হয় তল্লাশি।
রাত ১২টা ৫ মিনিট
পেছনের কম্পার্টমেন্টের সব লাগেজের তল্লাশি শেষ হয়। বিস্ফোরক জাতীয় কিছুই পাওয়া যায়নি। এরপর সামনের কম্পার্টমেন্ট খুলে সেখানকার লাগেজ তল্লাশি শুরু হয়।
রাত ১টা ০০ মিনিট
সর্বশেষ লাগেজ তল্লাশি শেষ হয়। গোটা বিমান, যাত্রী বা লাগেজ থেকে কোনো ক্ষতিকারক বস্তু পাওয়া যায়নি। অপারেশনের নেতৃত্বদানকারী সংস্থা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বোমা ডিস্পোজাল ইউনিট বিমানটিকে নিরাপদ ঘোষণা করে।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে রাত ১টা ৩০ মিনিটে সংবাদ সম্মেলন করতে আসেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান। তিনি বলেন, আমাদের কাছে একটি তথ্য ছিল। সেই তথ্যের ভিত্তিতে আমরা অপারেশনের প্রস্তুতি নিই।
তিনি বলেন, স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) অনুযায়ী বিমানটি ল্যান্ড করার পর আমাদের বাহিনী সেখানে মোতায়েন করি। এরপর যাত্রী নামিয়ে তল্লাশি, প্লেনের কেবিন, লাগেজ কম্পার্টমেন্টসহ সব জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়। ডেঞ্জারাস বা বোমাসদৃশ্য কিছুই পাইনি। রাত ১টায় সর্বশেষ লাগেজ স্ক্যান করে অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত করে ফ্লাইটটিকে নিরাপদ ঘোষণা করা হয়।
ফোনের বিষয়ে তিনি বলেন, বোমা থাকার বিষয়ে একটি মালয়েশিয়ান নম্বর থেকে ফোন কল এসেছিল। র্যাব বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে এ তথ্য জানিয়েছিল। তবে আমরা সঙ্গত কারণে ওই নম্বর কিংবা কলারের পরিচয় প্রকাশ করছি না।
গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ বলেন, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটিতে ১৩৫ জন যাত্রী ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন মালয়েশিয়ান নাগরিক, বাকিরা বাংলাদেশি। ফ্লাইটটি মালয়েশিয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা নিয়মিত ফ্লাইট ছিল।