মারা যাওয়ার কথা ছিল আমার। আমার বদলে চলে গেলেন বন্ধু ড. রফিকুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবং সাধারণ্যে পরিচিত ছিলেন নজরুল বিশেষজ্ঞ হিসেবে। মাত্র দুই দিন আগে বন্ধুবর মোনায়েম সরকার জানিয়েছিলেন, দেশের এই বরেণ্য বুদ্ধিজীবী হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছেন। আর মঙ্গলবার জানালেন, তিনি নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আমাদের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সমাজের শেষ আশার বাতি নিভে গেল। জাতির দুর্দিনে যাঁরা সাহসের সঙ্গে পাশে এসে দাঁড়াতেন, তাঁদের কেউ চলে গেছেন করোনায়, বাকি অংশ চলে গেলেন বার্ধক্যজনিত রোগে, কেউ অন্য কোনো রোগে। করোনা ও বার্ধক্যকে জয় করে রফিকুল ইসলাম এত দিন বেঁচে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ রক্ষার সংগ্রামে একজন সেনাপতি ছিলেন। আজ তিনিও চলে গেলেন।
এমন অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল রাজনীতিমনা পণ্ডিত আমি কম দেখেছি। আমরা সমবয়সী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ফজলুল হক হলের একই রুমে কিছুকাল থেকেছি। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। বিভিন্ন আন্দোলনে ক্যামেরা হাতে ছাত্র রফিকুল ইসলামকে দেখেননি, এমন প্রবীণ মানুষ কম আছেন।
১৯৫২ সালে ভাষামিছিলে গুলিবর্ষণের সময় আমি ও রফিকুল ইসলাম একসঙ্গে ছিলাম। শহীদ রফিকের মৃতদেহের ছবি তিনিই প্রথম তোলেন। এই ছবি তোলার সময় আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম। শহীদ রফিকের মৃতদেহ দেখেই আমি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতাটি লিখি। পরে রফিকুল ইসলামের সৌজন্যেই সেটি গান হয়।
রফিকুল ইসলামকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বার্ষিক বনভোজনে ছাত্রজীবনে, এমনকি শিক্ষকজীবনেও রফিকুল ইসলামই ছিলেন আমাদের সব কাজে হর্তাকর্তা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল হাই, ড. দীন মোহাম্মদ, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মতো তখনকার জ্ঞানতাপস শিক্ষকদেরও বনভোজনে ডেকে এনে তিনি আনন্দে-উল্লাসে মাতিয়ে তুলতেন।
একবারের এক স্মৃতি মনে আছে। আমরা জয়দেবপুরের কাছাকাছি শ্রীপুরে বনভোজনে গেছি। ট্রেনে থাকাকালেই রফিকুল ইসলাম ধরে ফেলেন আমাদের সঙ্গে সরকারি গোয়েন্দা বিভাগের এক ব্যক্তি ছদ্মবেশে আছেন। বাংলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে ধরে হয়রানির শিকার করতে চেয়েছিল। রফিকুল ইসলাম তাতে রাজি হননি। তিনি গোয়েন্দা অফিসারকে আমাদের সঙ্গে শ্রীপুরে নিয়ে যান, নাচ-গান ও ভোজনে অংশগ্রহণ করতে দেন এবং আমাদের সঙ্গে ঢাকায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।
একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে আমরা দুজনই ফজলুল হক হলে একা রয়ে গেছি। রফিকুল ইসলাম বললেন, চলুন, ময়মনসিংহে যাই, বেড়িয়ে আসি। তাঁর বাবা তখন রেলওয়েতে চাকরি করেন। ময়মনসিংহে পোস্টিং, সানন্দে রাজি হলাম। ময়মনসিংহে গিয়ে রফিকুল ইসলামের মাথায় বুদ্ধি চাপল—ময়মনসিংহের ২০ মাইল দূরে সাইকেলে চেপে একটি রাজবাড়ি দেখতে যাব, সেখানে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর প্রথম জীবনের সাধনপীঠ আছে। আছে বাংলাদেশের একমাত্র ঘুরন্ত থিয়েটার মঞ্চ। আছে একপাল হাতি। সেই শহরের তৈরি মিষ্টি দিল্লি পর্যন্ত রপ্তানি হয়। আমাদের সহযাত্রী হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠী ছাত্র। ফেরার পরে তাঁর সাইকেলের চাকা নষ্ট হয়। তাঁকেও নিজের সাইকেলে চাপিয়ে রফিকুল ইসলাম ময়মনসিংহ পর্যন্ত দীর্ঘপথ পাড়ি দেন।
ঢাকায় নবনাট্য আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন রফিকুল ইসলাম। শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে নেতৃত্বে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে শক্তিশালী নাট্য টিম গঠন করেছিলেন। এখন তো ঢাকা শহরে অভিনেত্রীর অন্ত নেই। তখন নাটকের নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য মুসলমান নারী পাওয়া যেত না। নারী চরিত্রে পুরুষদের অভিনয় করতে হতো। এই প্রথা ভাঙার জন্য রফিকুল ইসলাম আন্দোলন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ছাত্রী মাসুমা খাতুন, সাবেরা খাতুন ও জহরত আরা কার্জন হলে মঞ্চে অভিনয়ে নামেন। রফিকুল ইসলামও তাঁদের সঙ্গে অভিনয় করেন।
রফিকুল ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি। কিন্তু প্রগতিশীল বাম রাজনীতির ধারায় যুক্ত ছিলেন। বাংলা হরফ রক্ষা, রবীন্দ্রসংগীত রক্ষা ইত্যাদিসহ প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। পঞ্চাশের দশকে কবি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ মিলে পূর্ব পাকিস্তানে তরুণ সাহিত্যিক ও শিল্পীদের যে সংগঠন গড়ে তোলেন, রফিকুল ইসলাম তার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। এই সংগঠনের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ। এই সংগঠনের উদ্যোগেই ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিশাল নির্বাচনী জয়ের পর ঢাকায় একটি বাংলা সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর হোতাদের মধ্যে রফিকুল ইসলামও ছিলেন। এই সম্মেলনে কলকাতা থেকে মনোজ বসুসহ কয়েকজন নামকরা সাহিত্যিক এসেছিলেন।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৭ দিনের যুদ্ধের পর বাঙালি সাহিত্যিকদের নিয়ে সরকার একটি টিম গঠন করেছিল রণাঙ্গন পরিদর্শনের জন্য। এই টিমেও রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আমি ছিলাম। ভারতের খেমকারান অঞ্চলটি পাকিস্তান দখল করেছিল। সেই এলাকায়ও ঘুরে বেড়িয়েছি। রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আমার আরো অনেক স্মৃতি। কোনটা রেখে কোনটা লিখব আজ তা-ই ভাবছি। যদি আয়ুতে কুলায় ভবিষ্যতে লিখব।
আমার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য বিলাতে চলে আসায় দীর্ঘ কয়েক বছর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু আমি দেশে এলেই ছুটে আসতেন। তাঁর পাণ্ডিত্যের মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছেন। নজরুলকে নিয়ে গবেষণা করেছেন। হয়েছেন দেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় নজরুল বিশেষজ্ঞ। তিনি পরিণত বয়সেই মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু আমাদের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক জগতে যে শূন্যতা সৃষ্টি করে গেলেন, তা পূরণ করবে কে? আমি ঢাকায় গেলেই এই বয়সেও তিনি ছুটে আসতেন। এই ছুটে আসার মানুষটি আর নেই—এ কথা ভাবতে পারি না।
শেষবার যখন ঢাকায় যাই, তখন আরেক বন্ধু মোনায়েম সরকারের বাড়ির আড্ডায় রফিকুল ইসলামের সঙ্গে বাজি ধরেছিলাম, কে আগে চলে যাব? এই বাজিতে জিতে তিনি আজ চলে গেলেন। তবে দুঃখ নেই। আমি শিগগিরই তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করব। এই জ্ঞানসমৃদ্ধ মানুষটিকে শেষ প্রণতি জানাই।
লন্ডন, মঙ্গলবার, ৩০ নভেম্বর ২০২১