আওয়ামী লীগের জন্য তারেকের নতুন ট্র্যাপ

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। ফাইল ছবি

খালেদা জিয়া ছিলেন রাজনৈতিক নেত্রী। তাঁর দল বিএনপি শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাজনৈতিক সার্কাসের নায়িকা করে ছেড়েছেন। এখন বোঝা গেল বিএনপির হাতে আন্দোলন পরিচালনায় কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নেই। তাই গুরুতর দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ড হওয়ার পর থেকেই তাঁর গুরুতর অসুস্থতার কথাই ঢাক পিটিয়ে বলা হচ্ছে। বিএনপির দাবি সত্য হলে খালেদা জিয়ার এত রোগ নিয়ে বেঁচে থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনি সব অসুস্থতা নিয়ে বেঁচে আছেন। সুস্থ হওয়ার জন্য তাঁকে জামিনে মুক্তিদান করেছে সরকার। এখন বিএনপির তত্ত্বাবধানেই খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা চলছে। কিন্তু তাঁর অসুস্থতা সম্পর্কিত বিএনপির চিত্কার থামেনি। এখন দাবি তোলা হয়েছে দেশের উচ্চ আদালত দুর্নীতির দায়ে তাঁকে যে দণ্ড দিয়েছেন সেই দণ্ড মওকুফ করে তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার অনুমতি সরকারকে দিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, খালেদা জিয়ার দীর্ঘ কারাদণ্ডও মওকুফ করে দিতে হবে। এই প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি খালেদা জিয়ার জন্য তাঁর ক্ষমতানুযায়ী যতটা পেরেছেন ততটা করেছেন। তাঁর মানবিক সহানুভূতির জন্যই খালেদা জিয়া আজ জামিনে মুক্ত। কিন্তু উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারেন একমাত্র উচ্চ আদালতই।

দীর্ঘকাল ধরে খালেদা জিয়া নানা রোগে আক্রান্ত থাকায় অতি প্রচার ধীরে ধীরে মানুষের মনে বিশ্বাসযোগ্যতা ও তাঁর প্রতি বর্তমান সহানুভূতি হারাতে পারে। মিথ্যাবাদী রাখাল বালক যেমন গ্রামে বাঘ আসা সম্পর্কে বারবার মিথ্যা চিত্কার করে, যখন গ্রামে সত্যি সত্যি বাঘ এলো তখন তার চিত্কারে কেউ কান দিল না। সে বাঘের পেটে গেল। অনুরূপভাবে খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে রাজনীতির ইস্যু করে অতি প্রচার করা হলে যখন তিনি আশঙ্কাজনকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বেন, তখন তাদের চিত্কারে কেউ সাড়া দেবে না। অতএব বিএনপি, বিশেষ করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাবধান।

universel cardiac hospital

আসলে দেশের মাটির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়া চলে না। বিএনপির রাজনীতি পরিচালিত হয় লন্ডনে বসবাসরত তারেক রহমানের নির্দেশে। বাস্তবতার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক না থাকায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাঁর নির্দেশিত কোনো আন্দোলন সফল হয়নি। একটার পর একটা পরাজয় বিএনপি ও বিএনপি জোটকে বরণ করতে হয়েছে। সরকারের নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত হওয়ায় খালেদা জিয়া এখন মুক্ত। বিএনপির এবং তাঁর নিজের অঢেল সম্পত্তি। ইচ্ছা করলে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, সিঙ্গাপুর, বৈরুত, রিয়াদ থেকে যেকোনো নামকরা চিকিৎসক এনে তাঁর রোগের চিকিৎসা হতে পারে। তা না করে তাঁর মুক্তি ও বিদেশ গমনে অনুমতির অপেক্ষায় এই সময় হরণ রোগীর চিকিৎসা আরো জটিল করে তুলতে পারে।

আসলে তারেক রহমানের পরিকল্পনাই উদ্ভট। গত নির্বাচনেও এটা দেখা গেছে। বিস্ময়করভাবে নানা দলের, নানা মতের মানুষ এনে জড়ো করে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়েছিল। এই ফ্রন্ট গঠনের প্রথম দিনেই তারেকের পছন্দ নয়, দলের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন এমন ব্যক্তি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে চালাকি করে দল গঠনের কাজ থেকে বাইরে রাখা হয়। ফ্রন্ট অনেক হৈচৈ করে গঠন করা হলো। কিন্তু তা মুণ্ডুবিহীন। প্রাচীন ভারতের মুণ্ডুবিহীন কনিস্ক রাজার মতো। ইতিহাসে তাঁকে মুণ্ডুবিহীন সম্রাট বলে অভিহিত করা হতো। তারেক রহমানের এই যুক্তফ্রন্ট ছিল এক মুণ্ডুবিহীন যুক্তফ্রন্ট। ড. কামাল হোসেনকে তারেক রহমান ফ্রন্টের নেতৃত্ব দিতে ভয় পেয়েছেন। অন্যদিকে ড. কামাল হোসেন ভয় পেয়েছেন এই নেতৃত্ব গ্রহণে। তিনি ফ্রন্টের নেতা হতে চাইলেও হতে পারতেন না। বাধা তারেক রহমান ছিলেন এবং এই বাধাটাও ছিল প্রকাশ্য।

এখন বিএনপিকে ইলেকটেবল করার জন্য কোনো প্রকৃত রাজনৈতিক ইস্যুর বদলে খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে যে ইস্যু করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা তারেক রহমানের ইচ্ছায়। তাঁর দ্রুত রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছা থেকে এই চেষ্টার উদ্ভব। প্রকৃত রাজনৈতিক ইস্যুর মাধ্যমে গণ-আন্দোলন তৈরি করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার উপায় চক্রান্ত অথবা জনগণের মনের কোমল কোনো অনুভূতিকে বিভ্রান্ত করে তাঁকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করা। তারেক রহমান চক্রান্তের রাজনীতিতে এযাবৎ ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থ হয়ে জনগণের কোমল অনুভূতিকে এখন তাঁর ক্ষমতার রাজনীতিতে ব্যবহার করতে চাইছেন। মরণাপন্ন মা, যিনি আবার দেশের বিরোধী দলের নেত্রী, তাঁর ওপর জেলে ছিলেন, তাঁর জন্য জনগণের মনে বিপুল সহানুভূতি সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে।

এই সহানুভূতি সৃষ্টির উদ্দেশ্য দুটি। যদি সরকার জনগণের সহানুভূতির চাপে অথবা নিজেরাও খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতার জন্য তাঁকে বিদেশ পাঠাতে চায়, তাহলে তারেক রহমানের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। বাংলাদেশ সরকারের আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসা করা যায় কি না সে সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।’ মনে হয় সরকার তারেক রহমানের ইচ্ছা পূরণের পথেই চলেছে। তা-ই যদি হয়, খালেদা জিয়া হিথরো এয়ারপোর্টে পা দিয়েই অনেকটা সুস্থ হয়ে যাবেন। আর সুস্থ হয়ে বিলাতে বসে চলবে মাতা-পুত্রের সরকারবিরোধী নতুন নতুন অভিযান। হয়তো খালেদা জিয়া পুত্রের মতো জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও দেশে ফিরবেন না। ফিরবেন যদি তাঁর দল ও সমর্থকরা ছলে-বলে-কৌশলে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে তাঁকে রঙিন শাড়ি পরিয়ে রানির বেশে আবার ক্ষমতায় এনে বসাতে পারেন।

এই ধরনের পরিস্থিতিতে প্রকৃত লৌহমানবীর পরিচয় দিয়েছিলেন ব্রিটেনের এক সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। তাঁর আমলে আইরিশ সন্ত্রাসী দলের এক নেতা ববি স্যান্ডার্স বিপুল ভোটে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য হন। তবু মার্গারেট থ্যাচার তাঁকে মুক্তি দেননি। স্যান্ডার্স মুক্তির দাবিতে জেলে বসে শুরু করেন আমরণ অনশন। এই অনশনে তাঁর মৃত্যু হয়। তবু তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়নি।

এ ধরনের কঠোরতা আমাদের দেশের কোনো সরকারের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশের মাটি কোমল, মানুষের মনও তাই। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার বিদেশ গমনের সম্ভাবনাই বেশি। যদি তা না হয় সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দেন, তাহলেও সুবিধা তারেক রহমানের। স্বদেশে থাকাকালে খালেদা জিয়ার ভালো-মন্দ কিছু হলে সব দায় চাপানো হবে সরকারের ওপরে। তারেক বলতে চাইবেন সরকার খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে হত্যার চেষ্টা করেছিল। এই প্রপাগান্ডার গুরুত্ব বাংলাদেশে অনেক।

তারেক রহমান সৃষ্ট এই বিপাকে পড়ে সরকার খালেদা জিয়ার ব্যাপারে কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সরকারকে এখানে দৃঢ় চিত্ত হতে হবে। বিদেশে খালেদা জিয়া যাতে কোনো অবৈধ কার্যকলাপে লিপ্ত হতে না পারেন, তার যথাযথ ব্যবস্থা করে তাঁর বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। জওয়াহেরলাল নেহরুর স্ত্রী কমলা নেহরু গুরুতর অসুস্থ হলে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে তত্কালীন ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বিদেশে যেতে দিয়েছিল। আমার ধারণা, খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষয় হয়ে যাওয়া শক্তি। তারেক রহমান রাজনৈতিক কালা পাহাড়। আওয়ামী লীগের বিএনপিকে ভয় করার কিছু নেই। আওয়ামী লীগের ভয় করার বিষয় তার অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক দুর্বলতা। এবারের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও এই সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অনৈক্য প্রকাশ পেয়েছে। বর্তমান সরকারের দুজন মন্ত্রী—পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুুল মোমেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী দুজনই যথেষ্ট যোগ্য ব্যক্তি। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে তাই আমাদের সাফল্য অনেক। কিন্তু দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও কোন্দল আওয়ামী লীগ সরকারের বৈদেশিক নীতির সাফল্যগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের সব মন্ত্রী ও নেতাই ‘তাসের দেশের’ নায়কদের ভূমিকা ছেড়ে একটু সক্রিয় হন। তাঁদের কাণ্ডারি আছেন শেখ হাসিনার মতো শক্ত নেত্রী। তাঁদের ভয় করার কিছু নেই।

লন্ডন, রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২১

শেয়ার করুন