চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে তিন বিষয়ে গুরুত্বারোপ করলেন প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি হিসেবে তিনটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার মতে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে শিল্পের বিকাশ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনী সৃষ্টি এবং পরিবেশ সংরক্ষণ এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জাতির পিতা শেখ মুজিব স্বাধীনতা অর্জনের পর এই তিনটি বিষয়কে রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন বলে জানান তার কন্যা।

শনিবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলন-২০২১’ এর সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী।

স্বাধীনতার পর জাতির পিতার বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাক সেনারা আত্মসমর্পণের আগে ব্যাংক নোট জ্বালিয়ে দিয়েছিল। জাতির পিতা অর্থনীতিকে সচল রাখতে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সহায়তায় নোট ছাপিয়ে বাজারে সরবরাহ করেন। রাশিয়া ও জাতিসংঘের সহায়তায় চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে মাইন অপসারণ করেন। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুত সচল করেন। ভারী শিল্প, কলকারখানা, ব্যাংক, বিমা জাতীয়করণ করেন। পাকিস্তানিদের প্রায় ৫০০টি পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু করে লাখ লাখ নাগরিকের কর্মসংস্থান করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, জাতির জনক দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করেন; ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন। বিজ্ঞান ও গবেষণাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ‘কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করেন। দুর্ভাগ্য, জাতির পিতা মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। সংক্ষিপ্ত সময়েই তিনি শিক্ষা, কৃষি ও শিল্প খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছিলেন। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ৯ শতাংশের উপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। যা ধরে রাখতে পারলে পরবর্তী ১০ বছরেই বাংলাদেশ হয়ে উঠত তার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’।

সরকারপ্রধান বলেন, মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, নিত্যনতুন পণ্যের বাজার সৃষ্টি এবং কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনীতির গতিকে ত্বরান্বিত করাই ছিল শিল্পায়নের উদ্দেশ্য। প্রায় ১০০ বছর পরপর শিল্পায়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বিবর্তনের বিষয়টি লক্ষ্যণীয়।প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায় অতিক্রম করে আমরা আজ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি। এ পর্যায়ে সাশ্রয়ী এবং সবুজ ভ্যালু-চেইন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে- একদিকে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনকারী ও সহজে ব্যবহারকারী সম্পদশালী দেশগুলো এবং অন্যদিকে উক্ত ক্ষেত্রে বিনিয়োগে অক্ষম রাষ্ট্রপুঞ্জ।

শেখ হাসিনা বলেন, বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, অদূর ভবিষ্যতে মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। কিছু নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যেমন- মেশিন মানুষের কর্মক্ষেত্রকে সংকুচিত করবে; সস্তা শ্রমের চাহিদা কমে যাবে, অসমতা বৃদ্ধি পাবে এবং অভিবাসনকে উৎসাহিত করবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমবে এবং প্রযুক্তিজ্ঞান ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়বে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো যার যার গতিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে, যদি প্রযুক্তি সহজলভ্য এবং সহজে হস্তান্তরযোগ্য না হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর আমরা তথ্য-প্রযুক্তি অবকাঠামো স্থাপন, বিধিমালা প্রণয়ন এবং প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ নাগরিক সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কম্পিউটার কোর্স প্রবর্তন করি। প্রতিটি থানার একটি বিদ্যালয়ে এস.এস.সি ভোকেশনাল কোর্স চালু করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু কৃষি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিই। ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার কাজ শুরু করি। ১৫টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং তিনটি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করি।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ১১৭৬টি তীব্র দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করি। ১৯৯৮ সাল থেকেই দুই স্ট্রোক ইঞ্জিন-বিশিষ্ট ত্রি-চক্রযান নিষিদ্ধ করি। সকল কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক প্রত্যাহার করি। দেশী শিল্পের বিকাশ ও বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে যুগোপযোগী শিল্পনীতি প্রণয়ন করি। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রসারের লক্ষ্যে ৫৭টি শিল্প নগরী স্থাপন সম্পন্ন করি এবং ১৩টি শিল্প নগরী স্থাপনের কাজ শুরু করি। ২০০০-২০০১ অর্থবছরে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন চার হাজার ৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করি।

বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, ১৯৯১-৯৫ বিএনপির আমলে বাংলাদেশকে বিনামূল্যে ফাইবার অপটিক কেবল সংযোগ দিতে চাইলে তারা প্রত্যাখ্যান করে। দেশ আন্তর্জাতিক তথ্য-প্রযুক্তি মহাসড়ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। আমরা সরকারে এসে এই খাতের উন্নয়নে নতুন নীতিমালা গ্রহণ করি । সফটওয়্যার, ডাটা এন্ট্রি, ডাটা-প্রসেসিং শিল্পের বিকাশ ও রপ্তানি উন্নয়নের লক্ষ্যে আইটি-ভিলেজ এবং হাইটেক পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিই। শুল্কমুক্তভাবে কম্পিউটার, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ এবং সফটওয়্যার আমদানির অনুমোদন দিই।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মোবাইল ফোন এবং ভি-স্যাট স্থাপনায় মনোপলি ভেঙে দিয়ে তথ্য-প্রযুক্তি বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করি। ১৯৯৬ সালে মোবাইল ফোনের সংখ্যা ছিল মাত্র দুই হাজার আর প্রতিটির দাম ছিল এক লাখ টাকার বেশি। ২০০১ সালে মোবাইল টেলিফোনের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় সাত লাখ এবং দাম গড়ে সাত হাজার টাকা। ভি-স্যাটের সাহায্যে ডাটা আদান-প্রদান সহজ হওয়ায় কম্পিউটার ডাটা এন্ট্রি ও সফট্ওয়্যার রপ্তানির দ্বার উন্মুক্ত হয়। কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ তৈরি ও অ্যাসেমব্লিতে, সফট্ওয়্যার তৈরিতে এবং ডাটা প্রসেসিং কাজে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়।

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর হতে ধারাবাহিকভাবে আমরা সরকার গঠন করি। শিল্পখাতে উদ্ভাবনী প্রযুক্তির সন্নিবেশসহ ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য কাজ করি। ফলে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি অতিক্রম করেছে। শিগগির আমরা ৫-জি নেটওয়ার্ক সেবা চালু করছি। এটি ব্যবসার মডেল, শিক্ষা পদ্ধতি, জীবনযাত্রার মান এবং প্রচলিত ডিজিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দেবে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ডাকঘরগুলোকে ডিজিটাল সেন্টারে রূপান্তর করেছি। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোকে ফাইবার অপটিক্যাল তারে যুক্ত করেছি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করেছি, হাজার হাজার ইন্টারেক্টিভ কন্টেন্ট এবং ই-বুক ডিজাইন করেছি। ক্ষুদ্র/কুটির শিল্পপণ্যগুলোকে ই-কমার্স প্লাটফর্মে যুক্ত করেছি। আমরা অটোমেশন, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং ফ্রিল্যান্সিং ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান উন্নতি করছি। আমি বিশ্বাস করি অদূর ভবিষ্যতে আইসিটি ও সফটওয়্যার শিল্প আমাদের রপ্তানি খাতকে নেতৃত্ব দেবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশে গবেষণা উন্নয়ন এবং উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপনে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছি। নোকিয়া, স্যামসাং, হুয়াওয়েসহ অনেক কোম্পানি হাই-টেক পার্কগুলোতে কাজ করছে। উৎপাদন খাতে আমরা বৃত্তিয় অর্থনৈতিক মডেল’ গ্রহণ করছি, যার মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিরাপদ, পুনঃব্যবহারযোগ্য ও দীর্ঘস্থায়ী পণ্য উৎপাদন শুরু করেছি। ইতোমধ্যেই আমরা চাহিদার চেয়ে অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করেছি। রপ্তানি ক্ষেত্রে ১১টি সম্ভাবনাময় খাত চিহ্নিত করেছি। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টির মাধ্যমে অতিরিক্ত এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান করছি।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সৃষ্টি করেছি। এক্ষেত্রে আমি আমার আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে কৃতিত্ব দিতে চাই। আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই শিল্পোন্নয়নে (ISID) কাজ করছি। আমরা ‘এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছি। আমরা লক্ষ্য স্থির করে দেশ পরিচালনা করি। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পর এখন আমরা ‘উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ২০৪১ সালের মধ্যে যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছি, সেটাই হবে চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত, এই সম্মেলনে দেশ-বিদেশের বিপুলসংখ্যক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিল্পউদ্যোক্তাসহ অনেকেই অংশগ্রহণ করেছেন। তিনজন নোবেল বিজয়ী এবং ছয়জন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। দুটি সাইড ইভেন্ট ‘মুজিব-১০০ আইডিয়া কনটেস্ট’ এবং ‘মুজিব-১০০ ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সিবিট’ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সরকারপ্রধান বলেন, ১৭টি দেশ থেকে মোট ৫২৫টি গবেষণাপত্র জমা হয়েছে এবং তার মধ্য থেকে ১০০টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এছাড়া সহস্রাধিক আইডিয়া থেকে ১০টিকে সেরা হিসেবে বাছাই করা হয়েছে, যারা প্রত্যেকে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার পাবেন। আমি অংশগ্রহণকারীদের অভিনন্দন জানাই।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি, ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলন’ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আমি আশা করি, এই সম্মেলনে অর্জিত জ্ঞান আমাদের শিক্ষা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি নিবিড় বন্ধন সৃষ্টি করবে। ফলে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সম্পর্কিত গবেষণা এবং উদ্ভাবনকে বাস্তবে রূপদান করা সহজতর হবে।

শেয়ার করুন