শিক্ষক নেই তো পড়াবে কে?

ড. মো. ফখরুল ইসলাম

শিক্ষক
শিক্ষক। প্রতীকী ছবি

দেশে এত ডিগ্রিধারী বেকার মানুষ, এত চাকরিপ্রত্যাশী; তবু শিক্ষক নেই। শিক্ষক সংকট সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রয়েছে বলে বারবার সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। বিষয়টি বেশ শ্রুতিকটু। স্কুলে সহকারী শিক্ষকের নিয়োগ প্রদানের জন্য সেই কবে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। সহকারী শিক্ষকের আড়াই হাজার শূন্যপদে নিয়োগদান প্রক্রিয়ার ধীরগতির ফলে চাকরিপ্রত্যাশীরা ভীষণ হতাশ। তারা অনেকেই মেধাবী হওয়ায় ইতোমধ্যে ভিন্ন ও অপেক্ষাকৃত জনপ্রিয় পেশায় চলে গেছে।

এ পর্যায়ে বেশি অভিযোগ শোনা যাচ্ছে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানির বিষয়টি। মাধ্যমিকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য ২১৫৫ জনের চাকরি ঝুলে আছে। ভেরিফিকেশনে ধীরগতি ও রাজনৈতিক বিবেচনার নামে ছুতো খুঁজে বের করে হয়রানির মাত্রা চরম পর্যায়ে চলে গেছে বলে অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন। এ অভিযোগ সব ধরনের চাকরি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। এটি ঘুষ-দুর্নীতির প্রবণতাকে আরও বেশি উসকে দিয়েছে আমাদের সমাজে। কারণ, যারা এ সেবায় নিয়োজিত, তারা নিজেরা অনেক বেশি অর্থ খরচ করে চাকরি পেয়েছেন বলে নিজ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানা অবৈধ কায়দায় সেই অর্থ অর্জন করতে তৎপরতা চালাতে সচেষ্ট হয়ে পড়েন। ফলে সামাজিকভাবে দুর্বল শ্রেণির পরিবারের প্রার্থীদের ওপর নিয়মের খড়গের বোঝা নেমে আসে। অথচ একই চাকরি বা প্রমোশনের ভেরিফিকেশনের বেলায় কোনো প্রার্থীর পৃষ্ঠপোষকতায় হোমরা-চোমরা কেউ আছে, সেটি আঁচ করতে পারলে তারা নীরবে বিনা হয়রানিতে খুব দ্রুত তাদের কাজ করে দেন বলে জানা গেছে।

universel cardiac hospital

আধুনিক যুগে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি ও পক্ষপাতিত্বের কারণে এ ব্যবস্থা তুলে দেওয়া দরকার বলে অনেকে মনে করেন। কারণ, এ হয়রানি দিন দিন ঘুষ-দুর্নীতি, সামাজিক অস্থিরতা ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি ও তা বৃদ্ধি করে চলেছে। সরকার একটি সামাজিক শুমারির মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের পারিবারিক ডাটাবেজ তৈরি করে তা সরকারি ডাটাব্যাংকে রেখে দিলেই ঝামেলা চুকে যায়।

দেশের বহু উচ্চশিক্ষিত মেধাবী শত শত আবেদন করে চাকরি লাভ করতে না পেরে অবশেষে প্রাইমারি স্কুলে যোগদান করে। কারণ, বড় পদের সরকারি চাকরিতে প্রতিযোগিতা খুব বেশি। তার ওপর ভাইভা পর্যন্ত গিয়ে নানা ছলাকলার সম্মুখীন হয়ে অনেকই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একটি ‘ওপেন সিক্রেট’ যোগ্যতার কাছে নতজানু হয়ে বিফল হয়ে পড়ে। সব প্রার্থীর শক্তিশালী রাজনৈতিক ক্ষমতাধর আত্মীয়, বন্ধু বা সুপারিশকারী নেই। বেসরকারি চাকরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এ সমস্যা আরও প্রকট। কারণ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি সাধারণত নিজেদের আত্মীয় ও পরিচিতজনদের মধ্যে ভাগাভাগি করে পাওয়ার অলিখিত নিয়ম আমাদের দেশে বেশি প্রচলিত। কোনো প্রাইভেট ব্যাংক বা কোম্পানিতে বিশেষ যোগ্যতা ব্যতিরেকে মালিক বা পরিচালকমণ্ডলীর পরিজন ছাড়া চাকরি পাওয়া দুষ্কর। সেগুলোতে খালি পদ শূন্য পড়ে থাকে নিজেদের আপনজনের যোগ্যতা না হওয়া পর্যন্ত।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পার্টটাইমার দিয়ে ‘কাজ চালানোর’ প্রবণতা আরও বেশি। আমাদের দেশে শত শত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থায়ী শিক্ষক-কর্মচারী নেই। এমনকি বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভিসি-প্রোভিসি ও ট্রেজারারও নেই। অদৃশ্য কারণে দায়সারাভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সেগুলোতে রাতদিন ক্লাস নেন, পরীক্ষা নেন। তারা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও পড়ানোর যথেষ্ট সময় বের করতে পারেন না। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষক নিয়োগে কার্পণ্য করা হয় নানা কারণে। এভাবেই চলে আসছে আমাদের উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম। এভাবে নতুন নিয়োগ ও পদায়ন ছাড়াই চলছে তাদের কাজ।

অপরদিকে, বেকারদের যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সেগুলোতে স্থায়ী নিয়োগের সুযোগ বা চাকরি পাচ্ছেন না। কেউ কেউ অর্থাভাবে বা সময় কাটানোর জন্য সেগুলোতে ঢুকে যাচ্ছেন। বেতন বেশি পেলে প্রাইভেট ব্যাংকের চাকুরেরা ব্যাংক বদল করতে দেরি করেন না। অপরদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরতরাও একই কাজ করে থাকেন। ভালো অফার পেলেই হলো। গণিত, ইংরেজি, আইসিটি বা কম্পিউটারের শিক্ষকরা বেশি আয়ের সুযোগ পেলে এক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে ঘন ঘন চাকরি বদল করে থাকেন। বেসরকারি সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই সাময়িক চাকরি লাভ করেন তারা। তাই বেশি অর্থ পেলে কর্মরত প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে এক মিনিটও দেরি করেন না তারা। এ যেন প্রাইভেট টিউশনি করার মতো অবস্থা।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, ঘুস-দুর্নীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা প্রশাসকরা অনেক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু তাদের সেসব বিষয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি; বরং অধিকাংশ জায়গায় তারা সংযুক্ত হয়ে পড়েছেন ভৌত নির্মাণকাজে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪,১৫০টি শিক্ষকের পদ শূন্য। এক শ্রেণির ভিসি অবৈধ পন্থায় নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ প্রদান করে শিক্ষার কোয়ালিটিকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছেন। তাদের স্বেচ্ছাচারিতার তদন্ত শেষে অনেকের নামে এখন মামলা ঝুলে আছে। সেগুলোরও কোনো অগ্রগতির খবর শোনা যাচ্ছে না।

এসব দুরবস্থা নিরসনে প্রকৃত গবেষকদের মূল্যায়ন করতে হবে। ‘ফেয়ার ফ্যাকাল্টি নিয়োগ’ পদ্ধতি মেনে মেধাবী শিক্ষক ও গবেষক নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এক সময় অন্তঃসারশূন্যতা তৈরি হবে, যার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে অনুধাবন করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নিজেই। কারণ, শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় মেধাবীরা আসতে চায় না। এলেও থাকতে চায় না। ফলে আমরা হারাচ্ছি মেধা। শূন্য হচ্ছে পদ। এভাবে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গায় ক্রমাগত আসা-যাওয়ার মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষকের পদ খালি পড়ে থাকলে উপায় কী? ভালো শিক্ষক নেই, তো ভালোভাবে পড়াবে কে?

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান

শেয়ার করুন