বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী: অর্জন অনেক ক্রিকেটে

ডেস্ক রিপোর্ট

বাংলাদেশ ক্রিকেটের সমর্থক। ছবি: সংগৃহীত

স্বাধীন বাংলাদেশের পরের যুগে ক্রিকেট নিয়ে চর্চা হলেও উন্মাদনা ছিল না। মূলত নব্বইয়ের দশক থেকেই বাংলাদেশে ক্রিকেট জনপ্রিয় হতে শুরু করে। যদিও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ নামটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় ক্রিকেট দলের জয়োল্লাস ও বিজয়গাথাকে ঘিরেই। ১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় হয় বাংলাদেশ দলের। ৩৫ বছরে ঝুলিতে জমা পড়েছে অনেক অর্জন।

১৯৮৬

universel cardiac hospital

বাংলাদেশ প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে খেলে পাকিস্তানের বিপক্ষে—১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ, এশিয়া কাপে। শ্রীলঙ্কার মোরাতুয়াতে গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর নেতৃত্বেই প্রথম ওয়ানডে খেলে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। প্রথম ম্যাচটিতে বাংলাদেশ আগে ব্যাট করে ৯৪ রানে অলআউট হয়, ৭ উইকেটের ব্যবধানে জেতে পাকিস্তান।

১৯৯০

এশিয়া কাপে ক্রিকেটের নন্দনকানন খ্যাত ইডেন গার্ডেনে ১৯৯০ সালে মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। ৪৫ ওভারের ম্যাচে আগে ব্যাটিং করে শ্রীলঙ্কা ২৪৯ রান সংগ্রহ করে। ৬ উইকেটে ১০৮ রান তোলা বাংলাদেশের সেই ম্যাচকে আকর্ষণীয় করে তোলেন আতহার আলী। সনাথ জয়সুরিয়া-অরবিন্দ ডি সিলভার বলে বিশাল ছক্কা মেরে গ্যালারি মাতিয়ে তুললেন আতহার। সঙ্গীর অভাবে আতহারের ইনিংসটি সেদিন পায়নি পূর্ণতা। দলও জেতেনি। তবে নিজে খেলেছিলেন ৯৫ বলে ৭৮ রানের ইনিংস। ম্যাচ হারলেও ম্যাচ সেরার পুরস্কারটি ওঠে আতহারের হাতেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশি কোনও ক্রিকেটারের সেটিই প্রথম ম্যাচ সেরার পুরস্কার।

শুধু ব্যাটে-বলে প্রথম পুরস্কারই নয়, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে কথা বলার প্রথম পথটাও খুব ভালো করে দেখিয়ে দেন তিনি। ‘অ্যান্ড রশিদ ডিড হোয়াট ইজ টিপিক্যাল পাকিস্তানি স্টাইল’, ‘টেক দ্যাট অস্ট্রেলিয়া’ কিংবা বাংলা ওয়াশ-এই শব্দগুলো এখন তো ক্রিকেটপ্রেমীদের মুখে মুখেই।

১৯৯৭

বাংলাদেশ ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায় ১৯৯৭ সালে। ওই বছর লাল-সবুজ জার্সীধারীরা আইসিসি ট্রফি জেতে। বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত অন্যতম অর্জন ওটাই। এই জয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলেই চমক দেখিয়েছিল। হট ফেভারিট পাকিস্তানের পাশাপাশি স্কটল্যান্ডকেও হারিয়েছিল বাংলাদেশ।

১৯৯৮

প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার ২২ ম্যাচ পর জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ। পাক্কা ১২ বছর পর— ১৯৯৮ সালে ভারতের হায়দরাবাদে কেনিয়ার বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে জয় পায় বাংলাদেশ। প্রথম ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দেওয়া লিপু যা পারেননি, সেটাই করে দেখিয়েছেন আকরাম খান। যদিও জয়ের পুরো কৃতিত্ব মোহাম্মদ রফিকের বলা যায়। তার অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ।

শুধু তাই নয়, ওই বছর প্রথমবার আয়োজক হিসেবেও সাফল্য দেখায় বাংলাদেশ। ১৯৯৮ সালে স্বাধীনতার ২৫ বছর উপলক্ষে আয়োজন করা হয় স্বাধীনতা কাপ। ওই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত অংশ নিয়েছিল। একই বছর বাংলাদেশে আয়োজন করা হয় প্রথম আইসিসি নকআউট বা মিনি বিশ্বকাপ (এখনকার চ্যাম্পিয়নস ট্রফি)। আট দলের সেই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ না খেললেও সফল আয়োজকের ভূমিকায় ছিল।

১৯৯৯

৩১ মে, ১৯৯৯। নর্দাম্পটনে এদিনেই এসেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা জয়! এমনকি আইসিসির চোখে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা মুহূর্তের প্রথমটি হলো ’৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানো। দুর্দান্ত সব খেলোয়াড় নিয়ে সাজানো পাকিস্তানকে ৬২ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েছিল প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলতে নামা বাংলাদেশ। নর্দাম্পটনের ওই ম্যাচ দিয়েই পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ পেয়েছিল প্রথম জয়। ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপের সেই ম্যাচে আগে ব্যাট করে ৯ উইকেটে ২২৩ রান করেছিল বাংলাদেশ। জবাবে ব্যাট করেতে নেমে ৪৪.৩ ওভারে ১৬১ অলআউট হয় ওই আসরের ফাইনালিস্টরা।

২০০০

২০০০ সালের ২৬ জুন ৯টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের ভোটে টেস্ট ক্রিকেটের অভিজাত ক্লাবের দশম সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ। এই টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির মিশনে কেবল মাঠের পারফরম্যান্সই ভূমিকা রাখেনি, পেছনে ছিল অনেক কূটনৈতিক যুদ্ধও। যার নেতৃত্বে ছিলেন তখনকার বিসিবি সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী। ওই বছরের ১০ নভেম্বর নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের নেতৃত্বে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। প্রথম টেস্টে ১৪৫ রানের ইনিংস খেলে ইতিহাসে নাম লেখান আমিনুল ইসলাম বুলবুল। অধিনায়ক নাঈমুর রহমানের ১৩২ রানে ৬ উইকেট অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে কোনও বোলারের সেরা বোলিং। যদিও দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাটিং ব্যর্থতায় ৯ উইকেটে ম্যাচ হারে বাংলাদেশ।

২০০৫

টানা ১৬ ম্যাচে হেরে কোণঠাসা হয়ে পড়া বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত আলোর দেখা পায় ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি। টেস্টে অভিষেকের ৫ বছর পর ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জেতে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা এক দিন। ম্যাচ জয়ের নায়ক ছিলেন এনামুল হক জুনিয়র।

২০০৭

১৯৯৯ সালে নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপে দাপটের সঙ্গে খেললেও ২০০৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ছিল বাংলাদেশের জন্য দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপ। তবে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে চমক দেখায় লাল-সবুজের দল। পোর্ট অব স্পেনের আর্দ্র পিচে আগে ব্যাটিং করা ভারত ১৯১ রান তুলতেই অলআউট হয়। সেই রান ৯ বল আগেই তামিম, সাকিব ও মুশফিকরা তুলে ফেলেন ৫ উইকেট হারিয়েই। সাকিব, তামিম, মুশফিকের প্রথম বিশ্বকাপ হলেও তিনজনই করেছিলেন ভারতের বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি। যদিও মাশরাফি ৪ উইকেট নিয়ে ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ ভেঙে দিয়ে পেয়েছিলেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার।

২০১০

চীনের গুয়াংজুতে অনুষ্ঠিত হয় ২০১০ সালের এশিয়ান গেমস। এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য আসে ওই আসরেই। এ আসরে একটি স্বর্ণপদকসহ তিনটি পদক পায় বাংলাদেশ। ফাইনালে আফগানিস্তানকে ৫ উইকেটে হারিয়ে আশরাফুল, নাসির, সাব্বিরদের হাত ধরে ২০১০ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ পায় তার প্রথম স্বর্ণপদক।

২০১১

২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় বাংলাদেশ। অবশ্য এককভাবে নয়। ভারত, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ওয়ানডে বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক হয়েছিল বাংলাদেশ। সেবার ইংল্যান্ডকে হারিয়ে চমক দেখানো বাংলাদেশ তিনটি ম্যাচ জিতেও নক-আউট পর্বে যেতে পারেনি।

২০১২

ক্রিকেটের দুই পরাশক্তি ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠেছিল ওই বছর। কিন্তু ফাইনালে গিয়ে ২ রানের জন্য স্বপ্নভঙ্গ হয়। পাকিস্তানের বিপক্ষে ফাইনালে হেরে মিরপুরের ২২ গজ যেন ‘মরাবাড়ি’ হয়ে ওঠে। কেঁদেছেন সাকিব, নাসির, মুশিফকসহ দলের সবাই। কাঁদছিল পুরো দেশও। তবুও এশিয়া কাপে প্রথমবার ফাইনাল খেলাটাও বাংলাদেশের জন্য কম অর্জনের ছিল না।

২০১৪

ওয়ানডে বিশ্বকাপ না পারলেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের একক আয়োজক হয়েছিল বাংলাদেশ। ওয়ানডের মতো কুড়ি ওভারের বিশ্বকাপও সফলভাবে আয়োজন করে আইসিসির প্রশংসা কুড়িয়েছিলাম আমরা। যদিও ওই বিশ্বকাপে স্বাগতিক বাংলাদেশের মাঠের পারফরম্যান্স ভালো ছিল না।

২০১৫

২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে আরও একবার চমকে দেয় ক্রিকেট বিশ্বকে। রুবেলের চমৎকার বোলিংয়ে উড়ে যায় ইংল্যান্ড। প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ থেকে ফিরেও ঘরের মাঠে একই বাংলাদেশকে দেখা গেছে। ওই বছর পাকিস্তান-ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকাকে নাস্তানাবুদ করে সিরিজ জেতে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে মাশরাফির বাংলাদেশ।

২০১৭

এই বছর ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। আন্তর্জাতিক কোনও টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনাল খেলে বাংলাদেশ দল। কার্ডিফে সাকিব-মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরি করে নিউজিল্যান্ডকে বিদায় করে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছিলেন।

২০১৮

২০১৮ এশিয়া কাপে আবারও স্বপ্ন ভঙ্গ হয় বাংলাদেশের। শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে হারিয়ে এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠলেও শেষ হাসি হাসতে পারেনি ক্রিকেটাররা। আরেকবার ভারতের কাছে হেরে শিরোপা বঞ্চিত হয় মাশরাফির দল। ছেলেদের স্বপ্ন ভঙ্গ হলেও মেয়েরা সাফল্য পায় এশিয়া কাপে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা অর্জন এটি। ২০১৮ সালে সালমা খাতুনের নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার মাটিতে ফাইনালে ভারতকে হারিয়েই এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। একই আসরে সালমারা হারিয়েছিল পাকিস্তানকেও। ফাইনালে ৭ উইকেটে ভারতের বিপক্ষে জয়টি যেন এখনও সবার চোখে লেগে আছে।

২০১৯

মাশরাফির নেতৃত্বে অনেক আশা নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গেলেও প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি বাংলাদেশ দল। দক্ষিণ আফ্রিকা-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো বড় দুটি দলের বিপক্ষে জয় পেলেও সেটি যথেষ্ট ছিল না। তবে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে সবাইকে ছাড়িয়ে যান সাকিব আল হাসান। ২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিব আট ম্যাচে ব্যাট হাতে ৮৬.৫৭ গড়ে ৬০৬ রানের পাশাপাশি ১১টি উইকেট নিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে সাকিবই হয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি।

একই বছর বিশ্বকাপে ব্যর্থ হলেও আয়ারল্যান্ডে গিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলে বাংলাদেশ দল। স্বাগতিক আয়ারল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নিয়ে অনুষ্ঠিত সিরিজে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে বাংলাদেশ।

২০২০

চ্যাম্পিয়ন! বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন ইতিহাস লেখে বাংলাদেশের যুবারা। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা ঘরে আনে বাংলাদেশ দল। অনেক অপেক্ষার পর কুড়িতেই উনিশের বিশ্বজয় হয়েছে আকবর-শরীফুলদের হাত ধরে।

২০২১

গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ নারী দল বাছাইপর্ব টপকাতে না পারায় বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। তবে চলতি বছর ওমিক্রনের কারণে বাছাইপর্ব বন্ধ হয়ে গেলেও আগের র‌্যাংকিংয়ের ভিত্তিতে আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো খেলার সুযোগ পেয়েছে নারী ক্রিকেট দল।

শেয়ার করুন