নারী ও শিশু নির্যাতনের বিচারে ক্ষতিপূরণও নিশ্চিত করা হোক

সুরাইয়া পারভীন

নারী নির্যাতন
নারী নির্যাতন। প্রতীকী ছবি

নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ভুক্তভোগীর জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদানের নজির বিরল। এক্ষেত্রে আমরা সচরাচর শুধু অপরাধীর শাস্তি হতে দেখি। অপরাধী শাস্তি পেয়েছে দেখে আমরা স্বস্তি বোধ করি। কিন্তু যে নারী বা শিশুটি নির্যাতনের শিকার হলো তার কী পরিণতি হলো তার খোঁজ আমরা কতটুকু রাখি? নির্যাতনের কারণে সে শারীরিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিকভাবে যে অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়ল তা প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা আছে কি?

দিনাজপুরের শিশু শিখা (ছদ্ম নাম) ২০১৬ সালে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ৩৮ বছর বয়স্ক তার এক প্রতিবেশীর দ্বারা নৃশংসভাবে নির্যাতন এবং ধর্ষণের শিকার হয়। এতে শিখার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। নির্যাতন এবং রক্তক্ষরণের ফলে যখন তার শরীর সম্পূর্ণ নিস্তেজ হয়ে যায় তখন অপরাধী তাকে মৃত মনে করে বাড়ির পাশের হলুদ ক্ষেতে ফেলে দেয়। শিখাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাকে প্রথমে রংপুরে নেওয়া হয়েছিল চিকিৎসার জন্য কিন্তু তার আঘাত এবং শারীরিক অবস্থা জটিল হওয়ায় ডাক্তারদের পরামর্শে ঢাকায় আনা হয় চিকিৎসার জন্য। কয়েক মাসের চিকিৎসার ফলে শিখার অবস্থার যখন কিছুটা উন্নতি হয় তখন তাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়।

universel cardiac hospital

শিখা কি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল? সে একা থাকতে ভয় পায়, আবার বেশি মানুষ দেখলেও ভয় পায়। তাছাড়া প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে তার হাত-পা বাঁকা হয়ে গিয়েছিল, সে হাঁটতে পারত না, হাত দিয়ে শক্ত করে কিছু ধরতে পারত না। তাকে হাঁটানোর জন্য তার বাবা বাড়ির উঠানে বাঁশ বেঁধে নিয়মিত বাঁশ ধরে ধরে তাকে হাঁটার ব্যায়াম করাতেন। সে এখনও এক পা টেনে হাঁটে। সে প্রস্রাব ধরে রাখতে পারে না। তার শরীরে সারাক্ষণ প্রস্রাব এবং প্রস্রাবের গন্ধ থাকায় সহপাঠীরা অভিযোগ দেয়। এ কারণে লজ্জায় সে স্কুলে যায় না। এভাবে শিখার জীবনের আরও পাঁচটি বছর পার হয়ে গেছে।

এখন শিখার বয়স ১০ বছর। সুস্থ থাকলে এখন হয়তো সে নিয়মিত স্কুলে যেত, লিখতে-পড়তে শিখে যেতো কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও সে সুযোগ তার হয়নি। আমাদের রাষ্ট্র তাকে সে সুযোগ করে দিতে পারেনি। রাষ্ট্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার কারণে আজ শিখার এই পরিণতি। শিখার দরিদ্র মা-বাবাকে তার ডায়াপার কেনা এবং তার প্রস্রাবের কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্ট কেনার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মেয়েকে উন্নত চিকিৎসা করানোর সামর্থ্যই নেই। এ ঘটনায় অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা হয়েছে, অপরাধীও গ্রেপ্তার হয়েছে। মামলাটির রায় এখনও হয়নি। মামলার পেছনে দৌড়ানো এবং শিখার চিকিৎসার জন্য সময় দেওয়ার কারণে গত ৫ বছরে তার দরিদ্র বাবার আয়-রোজগারেও বিঘ্ন ঘটেছে। যদি অপরাধ প্রমাণিত হয় তাহলে অপরাধীর শাস্তি হবে। কিন্তু শিখা কি তার কষ্ট এবং যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে? শিখার তো সুস্থ, সুন্দর, আনন্দময় একটি জীবন হওয়ার কথা ছিল কিন্তু বিনা অপরাধে শিশু বয়সেই নোংরা নিষ্ঠুর এক নরপিশাচের লালসার শিকার হতে হয়েছে তাকে। সেই ক্ষত এবং যন্ত্রণা তার জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। কষ্ট ছাড়া জীবনে আনন্দের কোনো স্মৃতি মনে করতে পারে না ১০ বছরের শিখা। একটি সুস্থ জীবন পাওয়ার জন্য শিখা যেকোনো কষ্ট ভোগ করতে রাজি আছে। কাজেই শুধু অপরাধী শাস্তি পেলেই কি শিখা যন্ত্রণামুক্ত হয়ে যাবে? ঘটনাটির পর থেকে এখন পর্যন্ত শিখার মা-বাবার যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে তা পূরণের উপায় কি? শিখার সঙ্গে যে নৃশংসতা হয়েছে তার ফলস্বরূপ সে এখনও প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শিখার সুন্দর, সুস্থ জীবন যে অস্বাভাবিকতা আর অশান্তিতে ভরে গেলো তার বিচার কি শুধুই অপরাধীর শাস্তি? অপরাধীর জেল-জরিমানা হলেই কি শিখার সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে তার পরিপূর্ণ বিচার নিশ্চিত হবে?

এমন আরও নির্যাতনের শিকার নারী আছেন, যারা নির্যাতনের যন্ত্রণা এখনও বয়ে চলেছেন। নোয়াখালীর জবা (ছদ্ম নাম) এলাকার প্রভাবশালীদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন ২০১৮ সালে। ধর্ষণের সময় ধর্ষকরা তাকে প্রচণ্ড মারধর করে। এক্ষেত্রেও মামলা হয়েছে এবং বিচার কার্যক্রম নিম্ন আদালতে চলছে। রায় এখনও হয়নি। ঘটনার পর প্রায় ৩ বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু জবার সারা শরীরের ব্যথা এখনও যায়নি। এর জন্য তাকে প্রতি মাসে অনেক টাকার ওষুধ সেবন করতে হয়। তিনি গৃহিণী এবং তার স্বামী সিএনজি অটোরিকশা চালক। তার স্বামীর পক্ষে জবার ওষুধের খরচ চালানো খুবই কষ্টসাধ্য আর উন্নত চিকিৎসা করানোতো অসম্ভব ব্যাপার। জবা এখনও সন্ধ্যার পর ভয়ে ঘর থেকে বের হয় না। নির্যাতনের কারণে জবার যে শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতি হয়েছে এবং সে অর্থনৈতিক যে সমস্যার মধ্যে পড়েছে তাতো শুধু অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে পূরণ হবে না।

এমনি আরও একটি ঘটনা বলতে চাই। পাবনা জেলার একটি গ্রামে শারীরিক, মানসিক ও বাক্‌প্রতিবন্ধী কিশোরী মেয়ে নিপাকে (ছদ্ম নাম) নিয়ে তার বৃদ্ধ মা বাস করেন। তাদের পরিবারে আর কোনো সদস্য নেই। নিপার মা দরিদ্র। ছাগলের দুধ বিক্রি করে এবং এলাকার মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে অতি কষ্টে নিপাকে নিয়ে তার সংসার চলে। ২০২০ সালের প্রথম দিকে একদিন নিপাকে বাসায় একা রেখে তার মা বাইরে যান। এই সুযোগে তাদের এক প্রতিবেশী বাড়িতে ঢুকে হাত-পা বেঁধে নিপাকে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে এবং নিম্ন আদালতে বিচার কার্যক্রম চলছে। কিন্তু ঘটনার পর থেকে নিপা রাতে ঘুমোয় না। শুধু চিৎকার করে আর হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে। সে হাত পা ছুড়তে ছুড়তে প্রস্রাব-পায়খানা করে দেয়। নিপার মায়ের পক্ষে এই মেয়েকে সামলানো খুবই কষ্টকর। মেয়ের কারণে মাও রাতে ঘুমাতে পারেন না। নিপার মায়ের সামর্থ্য নেই মেয়ের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করানোর। অসহায় মা মেয়েকে বাসায় রেখে কোথাও যেতে পারেন না; আবার নিপার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার জন্য তাকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও যেতেও পারেন না। এমনকি মামলার খোঁজ নেওয়ার জন্য তিনি কোর্টেও যেতে পারেন না। তার ওপর আসামিদের পক্ষ থেকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন হুমকি আর চাপতো আছেই। এক্ষেত্রে অপরাধ প্রমাণিত হলে আসামির শাস্তি হবে নিশ্চিত কিন্তু নির্যাতনের কারণে নিপা আর তার মায়ের যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো, যে যন্ত্রণা তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিল তা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?

কাজেই নারী ও শিশু নির্যাতনের জন্য অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তির পাশাপাশি ভুক্তভোগী এবং তার পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এজন্য সুনির্দিষ্ট আইনি ব্যবস্থা থাকা জরুরি। কার্যকরী আইন এবং নীতিমালা প্রণয়ন করে আদালতের মাধ্যমে এই ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : অ্যাডভোকেসি এবং প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী, আমরাই পারি জোট

শেয়ার করুন