বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী: বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বিতর্কের শেষ কবে?

মোহাম্মদ সজিবুল হুদা

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে মরণপণ লড়াই চলে টানা নয় মাস ধরে
ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করে ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঙালি অর্জন করে মহত্তর বিজয়। এ বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পূর্ণ হয় ৫০ বছর। বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি উদযাপন করেছে মহান বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। তবে বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়ার পরও আমরা যারা নতুন প্রজন্ম তাদের মনে এখনও কতগুলো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিশেষ করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে, এটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলমান রয়েছে অনেক বিতর্ক। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ শোনা গেছে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ঢুকে পড়েছে, এমন অভিযোগ সরকার নিজেও স্বীকার করে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের পরিপত্র অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার (গেজেটভুক্ত) বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস ছিল, তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সে হিসাবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স হবে সাড়ে ৬১ বছর। কিন্তু ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রথম আলো পত্রিকার একটি রিপোর্ট করে, যেখানে সরকারি গেজেটভুক্ত প্রায় ২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে যাদের বয়স এখন ৫০ বছরই হয়নি! জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, তাঁদের কারও জন্ম ১৯৮২ সালে, কারও আবার ১৯৯১ সালে। এরপরও তাঁদের নাম রয়েছে ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়।

universel cardiac hospital

এমতাবস্থায় আমাদের প্রশ্ন হলো– এমনটি কী ভুলে হয়েছে?, নাকি অনিয়ম–জালিয়াতি করে কারও কারও নাম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ঢুকেছে। যদি ভুলে হয়ে থাকে তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, এতো বড় ভুল কীভাবে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়? তারা তাহলে সেখানে করেন কী? যদি অনিয়ম–জালিয়াতি করে কারও নাম ঢুকানো হয় সেটিও তো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কারণ মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধা বাঙালির সবচেয়ে আবেগের জায়গা, আর সেখানে যদি দুর্নীতির মাধ্যমে কোনো অ-মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করা হয় তাহলে সেটি হবে আমাদের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও অসম্মানের।

অবশ্য ঐসময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্রে হয়তো অনেকের বয়স ভুল লেখা হয়েছে। এটি সংশোধনের সুযোগ আছে। তবে অনিয়ম করে কারও নাম তালিকায় ঢুকেছে কি–না সেটি তদন্তের আগে নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কেউ অনিয়ম করে থাকলে তার নামও বাদ যাবে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ মন্ত্রীর সে বক্তব্যে আমরা নতুন প্রজন্ম আশ্বস্ত হয়ে ছিলাম যে- বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে চলমান বিতর্কের হয়তোবা একটা ফয়সালা এবার হবে। কিন্তু তারপর আরও এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও জালিয়াতির মাধ্যমে গেজেটভুক্ত প্রতারকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাগ্রহণ করেছেন কিনা অথবা বিষয়টি কোন অবস্থায় আছে সেটি নিয়ে জাতির সামনে এখন পর্যন্ত তিনি কিছুই স্পষ্ট করেননি। এমতাবস্থায় বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে নতুন প্রজন্মের সন্তান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীসহ এই দপ্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের নিকট একটাই প্রশ্ন– বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে বিতর্ক চলমান তার শেষ কবে হবে?

লেখক: সিনিয়র সাব-এডিটর, মত ও পথ

শেয়ার করুন