সালতামামি : ২০২১ সালে যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার বিশ্বকে চমকে দিয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

২০২১ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার
২০২১ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার। সংগৃহীত ছবি

করোনার বিষে নীল ছিল ২০২০। বিষক্ষয় হয়নি ২০২১ সালেও, যা দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে আরও ঢের। মহামারি করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে কেবল জনজীবনই নয়, বিপর্যস্ত হয়েছে দেশের অর্থনীতিও। তবে এ বছর কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। নতুন নতুন কিছু স্থান কিংবা আশ্চর্যজনক বিষয়ের আবিষ্কার ঘটেছে। যা আমরা অনেকেই খোঁজ রাখি না। প্রতিবছরই বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন আবিষ্কার হয়ে থাকে। তা সে নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার হোক বা প্রত্বতাত্ত্বিক। চলুন জেনে নেওয়া যাক এ বছর কোন কোন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার বিশ্বকে অবাক করেছে-

হাজার বছরের পুরোনো আংটি

universel cardiac hospital

বেগুনি রঙের বিস্ময়কর পাথর বসানো একটি সোনার আংটি। অবাক করা বিষয় হলো, এই আংটির বয়স কয়েক হাজার বছর। চলতি বছরের নভেম্বরে প্রত্নত্ত্ববিদরা এই দুর্মূল্যের আংটি আবিষ্কার করে ইজরায়েলের পুরাকীর্তি বিভাগ। ইজরায়েলের ইয়াভনে শহরের একটি পরিত্যক্ত পানশালা থেকে এটি আবিষ্কার করা হয়।

ধারণা করা হচ্ছে, মূল্যবান এই আংটির মালিক ছিলেন বাইজেন্টাইন শাসন আমলের কোনো এক ধনী ব্যক্তি। যিনি তৃতীয় থেকে সপ্তম শতকের মাঝামাঝি কোনো এক সময় ইজরায়েলে বসবাস করতেন। খুব সম্ভবত ওই ব্যক্তি সুরাপান করতে গিয়েছিলেন। নেশার ঘোরে হয়তো আংটি ফেলে আসেন সেখানে।

সপ্তদশ শতকের হারানো চিত্রকর্ম

সপ্তদশ শতকের শিল্পী রেমব্রান্টের আঁকা যিশুখ্রিস্টের একটি ছবি আবিষ্কৃত হয়েছে চলতি বছরে। জন্মের পর শিশু যিশুখ্রিস্টের সঙ্গে সেই তিন জ্ঞানী ব্যক্তির প্রথম সাক্ষাৎকার এই চিত্রের মূল বিষয়। ইতালির একটি গ্রামের দেওয়ালে টানানো ছিল চিত্রকর্মটি।

২০১৬ সালে মেঝেতে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ছবিটি। এরপর মেরামত করতে গিয়েই সামনে আসে ছবিটির অবাক করা তথ্য। জানা যায়, ছবিটি আঁকা হয়েছিল ১৬৩২-১৬৩৩ সালের দিকে। মাস কয়েক আগে ইতালির হেরিটেজ ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, চিত্রকর্মটি বিখ্যাত চিত্রকর রেমব্রান্টের সৃষ্টি।

আস্ত নগরী আবিষ্কার

এ বছরের সেরা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারটি ঘটেছে মিসরে। সেখানে আবিষ্কার হয়েছে একটি আস্ত নগরীর। এ নগরীর বয়স ৩ হাজার বছরেরও বেশি। মরুভূমির বালুতে ডুবন্ত অবস্থায় ছিলো শহরটি। মরুভূমির বুক চিরে মাত্র ১০ ফিট গভীর থেকে খুঁজে বের করা হয়েছে এই প্রাচীন নগর।

বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এটি এখনও পর্যন্ত মিশরে সন্ধান মেলা সবচেয়ে বড় প্রাচীন নগর। ২০২০ সালে মিশরের লুক্সর শহরে প্রথম হারানো এই নগরের সন্ধান মেলে। মিশরের ইতিহাস নিয়ে গবেষণারত প্রত্নতত্ত্ববিদ ও জনস্ হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেতসি ব্রায়ান জানিয়েছেন, তুতেনখামেনের সমাধির পর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার এটি।

এই শহরে আছে একটি সমাধিস্থান। সেখান থেকে বহু প্রাচীন কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়েছে। মিলেছে প্রাচীন বাসনপত্র, জাতাকল, কাঁচ ও কাপড় বোনার যন্ত্র, গয়না ইত্যাদি। সেখানে জিনিসপত্রগুলো এমনভাবে রাখা আছে যে দেখলে মনে হতে পারে সেগুলো সদ্যই সেখানে রাখা হয়েছে। ধারণা করা হয়, তৃতীয় আমেনহোটেপের সময় এই নগরী বেশ জমকালো ছিল।

বিশ্বের প্রাচীনতম গুহাচিত্র

৪৫ হাজার বছরেও বেশি পুরোনো এক গুহাচিত্র আবিষ্কার করা হয়েছে এ বছর। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপে প্রাচীন গুহাটি আবিষ্কৃত হয়। সেই গুহার দেওয়ালেই আঁকা ছিল ৪৫ হাজার ৫০০ বছরের পুরোনো চিত্রকর্মটি।

গুহাচিত্রে শূকরের মতো তিনটি প্রাণীকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকার অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দুটি প্রাণী লড়াই করছে আর একটি প্রাণী সেই লড়াই দেখছে।

লালচে রঙের পাথর বা অন্য কিছু দিয়ে ছবিটি আঁকা হয়েছিল। এর আগেও এই অঞ্চলে আরও কিছু গুহাচিত্রের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। এর মধ্যে একটি ৪৩ হাজার ৯০০ বছরের পুরোনো। সেটি একটি শিকারের ছবি।

বলিদানের স্থানে সোনার মুখোশ

চলতি বছরের জুন মাসে চিনের স্যানশিংদুই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে প্রায় ৫০০টি বলিদানের গর্ত আবিষ্কার করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। সেই গর্তেরই একটির মধ্যে থেকে মিলেছে একটি সোনার ভাঙা মুখোশ। মুখোশটি সোনার হালকা পাতে তৈরি। সেটি চিনের সাং রাজবংশের আমলের।

প্রায় ১০০ বছর আগে দক্ষিণ চিনের চেংদু শহরে স্যানশিংদুই স্থানটির খোঁজ পান স্থানীয় এক কৃষক। এরপর সেখানে শুরু হয় প্রাচীন ইতিহাসের খোঁজ। এরপর সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় হাজার হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

সোনার মুখোশটি সাম্প্রতিকতম নিদর্শন। অন্যান্য আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে হাতির দাঁতের তৈরি জিনিসের ধ্বংসাবশেষ, ব্রোঞ্জের মূর্তি ও একটি জেড ছুরি।

ছোট্টো এক পুঁতি

২০০০ সালের মাঝামাঝিতে আলাস্কার পূর্বাঞ্চলের মাটি খুঁড়ে ছোটো ছোটো পুঁতি পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেগুলো ইউরোপে তৈরি। গত জানুয়ারি মাসে ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, উত্তর আমেরিকায় প্রথম পৌঁছানো ইউরোপে তৈরি সামগ্রীর মধ্যে অন্যতম ছিল সেই পুঁতিগুলি।

গবেষণায় উঠে এসেছে, ওই পুঁতিগুলো ১৪৪০-১৪৮০ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকায় নেওয়া হয়। এর বেশ কয়েক বছর পর ১৪৯২ সালে আমেরিকায় পৌঁছেছিলেন কলম্বাস। গবেষকদের অনুমান, পঞ্চদশ শতকে ইতালির ভেনিস ও এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। তখনই হয়তো ইউরোপ থেকে সিল্করোড ধরে চিনে পৌঁছায় পুঁতিগুলো। সেখান থেকে যায় রাশিয়ার একেবারে পূর্বাঞ্চলে। এরপর বেরিং প্রণালি পেরিয়ে আর্কটিক হয়ে উত্তর আমেরিকার পথ খুঁজে নেয়।

পাণ্ডুলিপির অংশ আবিষ্কার

চলতি বছরের মার্চে কয়েক ডজন মৃতসাগরের পাণ্ডুলিপির অংশ আবিষ্কারের খবর জানায় ইজরায়েল সরকার। পাণ্ডুলিপির খণ্ডাংশেতে বাইবেলের বাণী লেখা ছিল বলে জানা গেছে। ইজরায়েলের অধীনস্ত পশ্চিমাংশের জুডিয়ান মরুভূমি থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেগুলো খুঁজে পান।

৩ হাজার বছরের চিত্র

মার্চ মাসেই পেরুর প্রাচীন মন্দিরের দেওয়ালে খোদিত এক চিত্রের হদিস পান প্রত্নতত্ত্ববিদরা। চিত্রকর্মের বয়স প্রায় ৩ হাজার ২০০ বছর। ছবিতে রয়েছেন ছুরি হাতে এক মাকড়সা দেবতা। পেরুর উত্তরাঞ্চলের এই মন্দিরটি অবশ্য আবিষ্কার হযেছিল ২০২০ সালে। মন্দিরের বেশিরভাগ অংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত।

অক্টাভিয়ানের মাথার প্রতিকৃতি

মে মাসে প্রাচীন রোমের প্রথম সম্রাট অগাস্টাস অক্টাভিয়ানের মাথার প্রতিকৃতির খোঁজ মেলে। মার্বেল পাথরের তৈরি প্রতিকৃতিটি ২ হাজার বছরের পুরোনো। ইটালির ইসার্নিয়া শহরে একটি মধ্যযুগীয় প্রাচীর সংস্কারের সময় এই প্রতিকৃতির সন্ধান মেলে।

তৃতীয় লিঙ্গের যোদ্ধার দেহাবশেষ

গত আগস্টে সামনে আসে আরেকটি চমকপ্রদ খবর। ফিনল্যান্ডে প্রস্তর যুগের একটি কবর থেকে একজন যোদ্ধার দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। ডিএনএ বিশ্লেষণ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, ওই যোদ্ধা তৃতীয় লিঙ্গের ছিলেন।

ভ্যান গঘের চিত্রকর্ম

অক্টোবরে, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের অলিভ গ্রোভ চিত্রকর্ম সংক্রান্ত নতুন আবিষ্কারের কথা জানায় ডালাস মিউজিয়াম অব আর্ট। একটি ছবির রঙের উপরে একটি পোকার লেজ আটকে আছে। সেটি দেখেই কোন স্থানে বসে ছবিটি আঁকা হয়েছিল তার খোঁজ চলছে।

পঞ্চবিংশ শতকের মন্দির

গত নভেম্বরে মিসরে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চবিংশ শতকের একটি মন্দির খুঁজে পান প্রত্নতাত্ত্বিকরা। সাড়ে ৪ হাজার বছরের পুরোনো মন্দির এটি। অনুমান করা হচ্ছে, মিসরের হারিয়ে যাওয়া সূর্য মন্দিরের একটি অংশ এই মন্দির।

মিসরের রাজধানী কায়রোর দক্ষিণে আবু গোরাবের পুরাকীর্তিসমৃদ্ধ একটি এলাকায় এই সূর্য মন্দিরটির আবিষ্কার করেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। মন্দিরের ভেতর বিশাল উঠানের মতো খালি জায়গা রয়েছে। এ ছাড়া ভেতরে রয়েছে বিশাল লম্বা একটি স্তম্ভ। সেখানেই মিলিত হয়ে সূর্যের আরাধনা করা হতো।

সূত্র: অল দ্যট ইন্টারেস্টিং

শেয়ার করুন